আগামী ৫ নভেম্বর মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। কে হতে যাচ্ছেন বিশ্বের সবচেয়ে পরাক্রমশালী দেশটির প্রেসিডেন্ট? সাবেক প্রেসিডেন্ট রিপাবলিকান প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প নাকি ভাইস প্রেসিডেন্ট ডেমোক্র্যাটিক প্রার্থী কমলা হ্যারিস। প্রেসিডেন্ট যে-ই হোন না কেন, এই নির্বাচন গাজা ও ইউক্রেনের যুদ্ধ, জলবায়ু পরিবর্তন এবং বৈশ্বিক বাণিজ্য থেকে শুরু করে প্রায় সব বিষয়েই ব্যাপক প্রভাব ফেলবে।
ইসরায়েল এবং গাজা
ইসরায়েলিরা যদি পারতো তবে ট্রাম্পের পক্ষে বেশ বড় মার্জিনে ভোট দিত। অন্তত সমীক্ষাগুলো তাই বলছে। তবে যে কেউ জিতুক না কেন, এর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব সম্ভবত সীমিতই থাকবে।
ইসরায়েলি সমাজ, সরকার তো বটেই ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রগঠন ও দুই রাষ্ট্র সমাধানের বিরোধিতা করছে। কমলা হ্যারিস প্রেসিডেন্ট হলে ইসরায়েলের ওপর যুদ্ধবিরতি ও ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে আলোচনা চালানোর জন্য বেশি চাপ প্রয়োগ করতে পারেন। তবে তিনি ইসরায়েলকে সামরিক সহায়তা বন্ধ করবেন, এমন সম্ভাবনা নেই।
অন্যদিকে ট্রাম্প সম্ভবত ইসরায়েলিদের গাজায় ইহুদি বসতি স্থাপনের অনুমোদন নিয়ে খুব বেশি উদ্বিগ্ন হবেন না। তিনি বরং ইরান বিষয়ে অনেক বেশি কঠোর কথা বলেন। যার ফলে অনেক ইসরায়েলি ট্রাম্পের ওপর সন্তুষ্ট। তবে অনেক ক্ষেত্রেই ট্রাম্পের অপ্রত্যাশিত আচরণের কারণে ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু হয়তো কমলার প্রশাসন থেকে আরও সুবিধা নেওয়ার কৌশল ভাবছেন।
রাশিয়া এবং ইউক্রেন
এই নির্বাচন রাশিয়া এবং ইউক্রেনের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিছু ইউক্রেনীয় উদ্বিগ্ন যে ট্রাম্প রাশিয়াকে পছন্দ করে। ফলে হয়ত ইউক্রেনকে দ্রুত শান্তিচুক্তির জন্য চাপ দিতে পারেন। তবে তারা উদ্বিগ্ন যে কমলার নেতৃত্বাধীন মার্কিন প্রশাসন ইউক্রেনকে সমর্থন কমিয়ে দিতে পারে।
এদিকে রাশিয়ায় প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের বিশ্বাস, যে-ই ক্ষমতায় বসুক, ইউক্রেনের প্রতি মার্কিন সমর্থন শেষ পর্যন্ত কমে যাবে। অবশ্য প্রকাশ্যে কমলাকে সমর্থন দিচ্ছেন পুতিন।
চীন
যে-ই জিতুক, পরবর্তী মার্কিন প্রেসিডেন্ট চীনের ব্যাপারে কঠোর অবস্থান নেবেন। তবে বেইজিংয়ের লোকজন বিভক্ত হয়ে আছেন কোন প্রার্থী চীনের জন্য ভালো হবে তা নিয়ে। চীনা অর্থনীতিবিদরা উদ্বিগ্ন। কারণ তাদের ধারণা ট্রাম্প চীনা রপ্তানির ওপর শুল্ক আরোপ করবেন যা চীনের অর্থনীতির জন্য মারাত্মক হুমকি হতে পারে। চীন তার অর্থনীতির বিশাল অংশ মার্কিন বাজারের ওপর নির্ভর করে। চীন মনে করে, ট্রাম্পের চেয়ে কমলা তার প্রতিবেশী দেশগুলির সাথে সম্পর্ক আরও শক্তিশালী করতে চেষ্টা করবেন।
ইউরোপ এবং ন্যাটো
যে ফলাফলই হোক না কেন ইউরোপের জন্য এই মার্কিন নির্বাচন যেন একটি যুগের অবসান। ইউরোপে বিভিন্ন ব্যক্তির সঙ্গে কথা বললে দেখা যায়,ট্রাম্পের জয় অনেকের কাছে এক দুঃস্বপ্ন, আবার অনেকের কাছে এক আশীর্বাদ। ইউরোপের ক্রমবর্ধমান ন্যাশনালিস্ট দলগুলো- যেমন: হাঙ্গেরি, ইতালি, জার্মানি ট্রাম্পকে তাদের আন্দোলনের নেতা হিসেবে দেখে। যদি ট্রাম্প আবারও হোয়াইট হাউসে ফিরে আসেন, তবে তিনি অভিবাসন এবং জাতীয় পরিচয়ের প্রশ্নে তাদের কট্টর অবস্থানকে স্বাভাবিক ও শক্তিশালী করতে পারেন।
তবে বেশিরভাগ পশ্চিম ইউরোপীয় নেতা উদ্বিগ্ন। কারণ যুক্তরাষ্ট্রে বিক্রি করা প্রতিটি পণ্যের ওপর ট্রাম্পের ২০ শতাংশ শুল্ক আরোপের কথাবার্তা ইউরোপের অর্থনীতির জন্য বিপর্যয় হতে পারে। এছাড়া ট্রাম্প ন্যাটো থেকে বেরিয়ে আসার বিষয়টিও বারবার উল্লেখ করেছেন। যদিও যুক্তরাষ্ট্র আনুষ্ঠানিকভাবে ন্যাটো ছাড়বে না। তবুও ট্রাম্প বলতে পারেন, তিনি ইউরোপীয় দেশের জন্য যুদ্ধ করবেন না। এতে জোটের বিশ্বাসযোগ্যতা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।
যদি কমলা হ্যারিস জিতেন তবে ধারণা করা হয় তিনিও ঘরোয়া বিষয়গুলো নিয়ে ব্যস্ত থাকবেন এবং চীনের বিষয়ে আরও মনোযোগী হবেন। ফলে ইউরোপীয়দের আরও বেশি নিজের দায়িত্ব নিতে বলবেন। ফলে দেখা যাচ্ছে, বাইডেন হয়তো শেষ মার্কিন প্রেসিডেন্ট, যিনি এই জোটের প্রতি ব্যক্তিগতভাবে সংযুক্ত ছিলেন।
বিশ্ব বাণিজ্য
ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেন, ‘ট্যারিফ’ শব্দটি ‘ডিকশনারির সবচেয়ে সুন্দর শব্দ। ভালোবাসা বা সম্মানের চেয়েও সুন্দর।’ সুতরাং, এই নির্বাচন অনেক কিছুর পাশাপাশি পুরো বৈশ্বিক বাণিজ্য ব্যবস্থার ওপর একটি গণভোট। আমেরিকার ভোটাররা এমন একটি সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন যা সমগ্র বিশ্বের ওপর প্রভাব ফেলতে পারে।
কমলা হ্যারিস নির্বাচিত হলে তিনি জাতীয় নিরাপত্তার কারণে চীনা পণ্যের ওপর লক্ষ্যভিত্তিক ট্যারিফ বজায় রাখবেন। আর ট্রাম্প প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন, অধিকাংশ বিদেশি পণ্যের ওপর ১০ থেকে ২০ শতাংশ এবং চীনের তৈরি পণ্যের ওপর ৬০ শতাংশ বা তারও বেশি ট্যারিফ আরোপ করবেন।
বেশিরভাগ অর্থনীতিবিদ বলছেন, এর ফলে আরো বেশি ট্যারিফ, কম বাণিজ্য, কম আয় ও প্রবৃদ্ধি হতে পারে - অর্থাৎ বিশ্ব আরও গরীব হয়ে যাবে।
দক্ষিণ আফ্রিকা
আফ্রিকার মানুষ কমলা ও ট্রাম্পের প্রতি ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করেন। যদিও ট্রাম্প আফ্রিকার দেশগুলোকে বর্বরভাবে অপমান করেছেন। তবু কিছু লোক তাকে এক শক্তিশালী নেতা হিসেবে দেখেন। অনেকভাবে তিনি আফ্রিকার অনেক স্বৈরাচারী নেতার সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ।
আফ্রিকায় কমলাকে কেউ কেউ জানেন তার ছোটবেলায় জাম্বিয়ায় সময় কাটানোর জন্য। সেখানে তিনি একজন ভারতীয় কূটনীতিকের নাতনী হিসেবে ছিলেন। আফ্রিকার জনগণের সাথে তার বিশেষ সংযোগ রয়েছে যা গভীরভাবে প্রতিধ্বনিত হয়।
কমলা হ্যারিস চান আফ্রিকার দেশগুলো তাদের কার্বন নির্গমন কমাক। কারণ অনেক দেশ এখনও শক্তির জন্য জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর নির্ভরশীল। ট্রাম্প সম্ভবত এই বিষয়ে কোনও জোর দেবেন না। ফলে তার প্রেসিডেন্সি হয়তো কয়লা, তেল ও গ্যাসের মতো জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহার চালিয়ে যেতে ইচ্ছুক দেশগুলির জন্য আকর্ষণীয় হতে পারে।
মেক্সিকো
ট্রাম্প নির্বাচিত হলে মেক্সিকো উল্লেখযোগ্য চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হবে। যুক্তরাষ্ট্র-মেক্সিকো সীমান্তে উত্তেজনা প্রায় নিশ্চিতভাবে বাড়বে। মেক্সিকো যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় বাণিজ্যিক অংশীদার, এবং এটি কঠোর ট্যারিফের সম্মুখীন হতে পারে। এটি এমন এক রাষ্ট্রের প্রতিবেশী হবে যার প্রেসিডেন্ট মেক্সিকোর মাটিতে মার্কিন সামরিক বাহিনী ব্যবহার করার হুমকি দিয়েছেন।
তবে মেক্সিকো প্রত্যাশা করে, যে-ই জিতুক কঠোর অভিবাসন নীতি বজায় থাকবে। কারণ অভিবাসন একটি যৌথ ইস্যু। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে অভিবাসীরা মেক্সিকো হয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সীমান্তে পৌঁছায়। যুক্তরাষ্ট্র মেক্সিকোর সহায়তা ছাড়া অভিবাসন নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে না।
প্রেসিডেন্ট হলে ট্রাম্প ১১ মিলিয়ন মানুষকে বহিষ্কারের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, যার বেশিরভাগই লাতিন আমেরিকায়। যদিও বিশেষজ্ঞরা সন্দিহান যে এটি বাস্তবায়ন করা সম্ভব। তবু অল্প সংখ্যক বহিষ্কারও পুরো অঞ্চলে বিশাল প্রভাব ফেলতে পারে।
জলবায়ু
বিশ্বের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে জলবায়ুর ওপর। যুক্তরাষ্ট্র ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি কার্বন নিঃসরণকারী দেশ এবং বর্তমানে চীনের পরে দ্বিতীয় বৃহত্তম। এ বিষয়ে যা করা হবে, তা পুরো বিশ্বের ওপর প্রভাব ফেলবে।
কমলা হ্যারিস নির্বাচিত হলে, তিনি সম্ভবত বাইডেনের নবায়নযোগ্য শক্তিতে রূপান্তর এবং কার্বন নিঃসরণ হ্রাসের নীতিগুলোর ওপর জোর দেবেন। কিন্তু তিনি কি তেল ও গ্যাস উৎপাদনে নিষেধাজ্ঞা দেবেন? এটি এখনও পরিষ্কার নয়।
আর ট্রাম্প নির্বাচিত হলে কয়েক ডজন নির্গমন নিয়ন্ত্রণ বিধান উল্টে দিতে পারেন, যার ফলে দ্রুত নির্গমন হ্রাসে দেশের সক্ষমতা হ্রাস পেতে পারে। এতে চীন নিঃসন্দেহে উপকৃত হবে। কারণ ট্রাম্পের কর্মকাণ্ড তাদের পুনরায় ব্যবহারযোগ্য প্রযুক্তি যেমন: ব্যাটারি ও বৈদ্যুতিক গাড়ির ক্ষেত্রকে আরও এগিয়ে দেবে।
মার্কিন নির্বাচনে যে-ই জিতুক, শক্তির রূপান্তর ইতোমধ্যেই শুরু হয়েছে। তবে গতি ও মাত্রার বিষয়টিও গুরুত্বপূর্ণ। ট্রাম্প হয়তো এই রূপান্তরকে থামিয়ে দিতে পারেন যা জলবায়ু এবং পুরো বিশ্বের জন্য বিপর্যয়কর হতে পারে।
সূত্র: দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস