আর্কাইভ | ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২০ নভেম্বর ২০২৫, ৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩২, ২৮ জামাদিউল আউয়াল ১৪৪৭ ০৫:১৩:০২ পূর্বাহ্ন
Photo
বিশেষ প্রতিবেদক 
ঢাকা, প্রকাশিতঃ
২১ অক্টোবর ২০২৫
০৫:২০:৫২ পূর্বাহ্ন

জবির জুবায়েদ হত্যা: 'পুরোটাই ত্রিভুজ প্রেমের কাহিনী' 


জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদল নেতা জুবায়েদ হোসাইনকে হত্যাকাণ্ডের 'রহস্য উদঘাটনের' দাবি করে পুলিশ বলছে, এখানে রাজনৈতিক কোনো বিষয় জড়িত নেই; ‘ত্রিভূজ প্রেমের’ কারণে এই হত্যাকাণ্ড ঘটেছে।

জুবায়েদ হত্যায় এ পর্যন্ত তিনজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (ক্রাইম এন্ড অপারেশনস্) এস, এন, মো. নজরুল ইসলাম।

গ্রেপ্তার তিনজন হলেন- জুবায়েদের ছাত্রী তার প্রেমিক এবং ওই প্রেমিকের বন্ধু ২০ বছর বয়সী ফারদীন আহম্মেদ আয়লান। এই তিনজনের নামে সকালে বংশাল থানায় জুবায়েদের ভাই এনায়েত হোসেন মামলাটি দায়ের করেন। তিনজন ছাড়াও অজ্ঞাত আরও চার থেকে পাঁচজনকে আসামি করা হয়েছে।


জুবায়েদ হত্যার পর তিনজনকে গ্রেপ্তারের তথ্য দিতে মঙ্গলবার দুপুরে ডিএমপি মিডিয়া সেন্টারে সংবাদ সম্মেলনে এসে অতিরিক্ত কমিশনার নজরুল ইসলাম বলেন, এই ঘটনাটির সঙ্গে বরগুনার রিফাত হত্যায় তার স্ত্রী মিন্নির জড়িত থাকার ওই ঘটনার সমাঞ্জস্য পাওয়া গেছে

"এটা মিন্নির ঘটনার সাথে মোটামুটি সিমিলার।"

তিনি বলেন, "এখানে রাজনৈতিক কোনো বিষয় নাই, এটা কমপ্লিটলি ত্রিভুজ প্রেমের কাহিনী। এটাকে রাজনৈতিক কালার দেওযার কোন সুযোগ নাই। আমরা এমন কিছু পাইওনি।"

অতিরিক্ত কমিশনার নজরুল বলেছেন, পাশাপাশি বাড়িতে ওই মেয়েটি ও তার প্রেমিকের বেড়ে ওঠা ছোটবেলা থেকে। তাদের প্রেমের সম্পর্ক ছিল দেড় বছরের মত। আর জুবায়েদ মেয়েটিকে তার বাড়িতে যেয়ে পড়াতেন প্রায় এক বছর ধরে।

“এক পর্যায়ে উভয়ে প্রেমের সম্পর্কে জড়ায়।”

প্রায় একমাস আগে পুরনো প্রেমিক জানতে পারে, জুবায়েদের সঙ্গে মেয়েটির প্রেমের সম্পর্ক আছে। বিষয়টি মেনে নিতে না পারায় তাদের মধ্যে ঝগড়া-বিবাদ হয়।


পুলিশ কর্মকর্তার ভাষ্য, “মেয়েটি তখন তার পুরনো প্রেমিককে বলে, ‘জুবায়েদকে না সরাতে পারলে তোমার সাথে থাকতে পারব না'। এমন প্রেক্ষিতেই তারা জুবায়েদকে হত্যার পরিকল্পনা করে।

“সে অনুযায়ী জুবায়েদের পড়াতে আসার এবং চলে যাওয়ার সময় প্রেমিককে জানিয়ে দেয় মেয়েটি। এরপর ছেলেটি তার বন্ধু আয়লানকে হত্যার পরিকল্পনার বিষয়টি জানায় এবং তারা দুজনে কেরাণীগঞ্জ থেকে 'হত্যায় ব্যাহৃত' ৫০০ টাকা দিয়ে সুইচ গিয়ার চাকু কিনে আনে। ঘটনার দিন বিকাল সাড়ে ৪টার দিকে মেয়েটির বাসার নিচে জুবায়েদকে পেয়ে তার প্রেমিক ও আয়লান তাকে ধরে। এবং জুবায়েদের সঙ্গে তার ছাত্রীর প্রেমের বিষয়ে জিজ্ঞাসা করে। এ নিয়ে 'বাকবিতণ্ডার' এক পর্যায়ে প্রেমিক তার ব্যাগে থাকা সুইচ গিয়ার চাকু বের করে জুবায়েদের গলার ডান পাশে পোচ দেয়, যাতে তার মৃত্যু হয়।”

ওই রাতেই মেয়েটিকে পুলিশ হেফাজতে নিয়েছে জানিয়ে ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার বলেন, পরদিন বাকি দুজনকে গ্রেপ্তার করা হয়।

হত্যাকাণ্ডের পুরো ঘটনার সময় মেয়েটি তার বাসার তৃতীয় তলায় দাঁড়িয়ে ছিল জানিয়ে পুলিশের লালবাগ বিভাগের উপকমিশনার মল্লিক আহসান উদ্দিন সামী বলেন, "ছুরিকাঘাতের পর জুবায়েদ সিঁড়ি বেয়ে তৃতীয় তলায় গিয়ে মেয়েটিকে দেখতে পায়। তখন তার কাছে জুবায়েদ বলেছিল 'আমাকে বাঁচাও'।

"এর জবাবে মেয়েটি বলেছিল, 'তুমি না সরলে আমি আমার প্রেমিকের হব না'। এ কারণে মেয়েটি কোনো হেল্প করেনাই, এরমধ্যে জুবায়েদ পড়ে গেছে।"

এক প্রশ্নের জাবাবে অতিরিক্ত কমিশনার নজরুল বলেন, "মেয়েটি দুইদিকেই সম্পর্ক বজায়ে রাখছে। হয়তো সে ডিসিশান নিতে পারছিল না। ছোট মানুষ, তার আগের প্রেমিক ব্যাপারটা জানার পর হয়ত চাপ দিয়েছে। এরপর ২৬ সেপ্টেম্বর থেকেই মেয়েটি ও তার আগের প্রেমিক মিলে জুবায়েদকে হত্যার পরিকল্পনা করে।"

মেয়েটি পড়ে ঢাকা মহানগর মহিলা কলেজে দ্বিতীয় বর্ষে। আর ওই কলেজছাত্র পুরান ঢাকার শেখ বোরহান উদ্দীন কলেজে উচ্চ মাধ্যমিকে প্রথম বর্ষে পড়ে।

জুবায়েদ জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০১৯-২০ শিক্ষাবর্ষের পরিসংখ্যান বিভাগের শিক্ষার্থী ছিলেন। তিনি বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রদলের আহ্বায়ক কমিটির সদস্য ছিলেন। এছাড়া কুমিল্লা জেলা ছাত্র কল্যাণ সংসদের সভাপতির দায়িত্ব পালন করছিলেন।


গেল রোববার জুবায়েদকে ছুরিকাঘাতের পর সিঁড়ির নিচতলা থেকে তিনতলা পর্যন্ত রক্ত পড়েছিল। তিনতলার সিঁড়িতে উপুড় হয়ে পড়েছিল নিথর জুবায়েদ।

তার মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়া মাত্র ঘটনাস্থলে জড়ো হন তার সহপাঠী, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ও বর্তমান শিক্ষার্থীসহ ছাত্রদলের নেতাকর্মীরা। বিচারের দাবিতে তারা বিক্ষোভ দেখান তারা।

এরপর পুলিশ ওই বাসায় ওই ছাত্রী ও তার পরিবারের সদস্যদের প্রায় ৫ ঘণ্টা ধরে জিজ্ঞাসাবাদ করে। তারপর রাত ১১টায় ওই ছাত্রীকে হেফাজতে নেয় পুলিশ।

পরে এ হত্যাকাণ্ডের বিচার দাবিতে শিক্ষার্থী ও ছাত্রদলের নেতাকর্মীরা রাত পৌনে ১১টার দিকে তাঁতীবাজার এলাকায় প্রধান সড়ক অবরোধ করে। প্রায় এক ঘণ্টা রাস্তা আটকে রাখার পর রাত পৌনে ১২টার দিকে তারা মিছিল নিয়ে বংশাল থানার দিকে রওনা হয়। পরে সেখানে অবস্থান করে টায়ার পুড়িয়ে তারা বিক্ষোভ দেখান।

এদিকে এই হত্যাকাণ্ডে সন্দেহভাজন হিসেবে রোববার সন্ধ্যা থেকেই ওই কলেজছাত্রের নাম এবং ছবি ছড়িয়ে পড়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। এরপর সোমবার সকালে ওই কলেজছাত্রের মা রেখা আহমেদ ছেলেকে নিয়ে গিয়ে বংশাল থানায় হস্তান্তর করে বলে তার স্বজনেরা জানিয়েছেন।

জুনায়েদ হত্যা মামলার অভিযোগে বলা হয়েছে, “জুবায়েদ হোসাইন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার পাশাপাশি টিউশন করতেন। প্রতিদিনের মত তিনি রোববার (১৯ অক্টোবর) বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে বংশাল থানার ৩১ নম্বর ওয়ার্ডের নুর বক্স লেনের ১৫ নম্বর হোল্ডিং রৌশান ভিলায় তার ছাত্রীকে প্রাইভেট পড়ানোর জন্য যান। সন্ধ্যা ৫টা ৪৮ মিনিটের দিকে মেয়েটি জুবায়েদের বিশ্ববিদ্যালয়ের ছোট ভাই সৈকতকে ফেইসবুকের মেসেঞ্জারের মাধ্যমে জানান যে, জুবায়েদ স্যার খুন হয়েছে। কে বা কারা খুন করেছে।”

সন্ধ্যা ৭টার দিকে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র মো. কামরুল হাসান মামলার বাদী জবায়েদের ভাইকে মোবাইল ফোনের মাধ্যমে বিষয়টি জানান। এনায়েত হোসেন তার শ্যালক শরীফ মোহাম্মদকে সাথে নিয়ে মোটর সাইকেলে ওইদিন রাত সাড়ে আটটার দিকে ঘটনাস্থল রৌশান ভিলায় পৌঁছান।

এই হত্যা মামলার বিবরণে এনায়েত হোসেন সৈকত বলেন, “ঘটনাস্থলে গিয়ে রৌশান ভিলা ভবনের নিচতলা থেকে উপরে উঠার সময় সিঁড়ি ও দেয়ালে রক্তের দাগ দেখা যায়। ওই ভবনের তৃতীয় তলার রুমের পূর্ব পাশে সিঁড়িতে গেলে সিঁড়ির ওপর জুবায়েদের রক্তাক্ত মরদেহ উপুড় অবস্থায় দেখা যায়। সুরতহাল প্রস্তুত করার সময় তার গলার ডান পাশে ধারালো অস্ত্রের আঘাতের চিহ্ন দেখা গেছে। ঘটনাস্থলে উপস্থিত লোকজনের কাছ থেকে জেনে এবং আশপাশের এলাকার ক্লোজড সার্কিট ক্যামেরার ভিডিও ফুটেজ দেখে উল্লিখিত আসামিরাসহ অজ্ঞাত বিবাদীরা আমার ভাইকে পূর্ব-পরিকল্পিতভাবে ধারালো অস্ত্র দিয়ে গলার ডান পাশে আঘাত করে হত্যা করেছে বলে নিশ্চিত হই।

পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে পরামর্শ করে আমি বাদী হয়ে মামলা করেছি। মামলায় যারা প্রকৃত আসামি আমরা তাদের নাম উল্লেখ করেছি। আমরা চাই কোনো নির্দোষ ব্যক্তি যেন ফেঁসে না যায়। যারা প্রকৃত অপরাধী তারাই শাস্তি পাক।