আর্কাইভ | ঢাকা, বুধবার, ৩০ জুলাই ২০২৫, ১৫ শ্রাবণ ১৪৩২, ৩ সফর ১৪৪৭ ১১:১৪:২৫ অপরাহ্ন
Photo
বিশেষ প্রতিবেদক 
ঢাকা, প্রকাশিতঃ
২৪ জুলাই ২০২৫
০৮:৫১:৩৭ পূর্বাহ্ন

সাবেক প্রধান বিচারপতি খায়রুল হক দেশেই ছিলেন


তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিলের রায় ঘোষণাকারী আলোচিত সাবেক প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হককে গ্রেফতার করা হয়েছে। বৃহস্পতিবার (২৪ জুলাই) রাজধানীর ধানমন্ডির নিজের বাসা থেকে তাকে গ্রেফতার করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। সকাল ৮টার দিকে তাকে বাসা থেকে গ্রেফতার করে ডিবি কার্যালয়ে নেয়া হয়। যাত্রাবাড়ী থানার বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনকালীন হত্যার ঘটনায় করা মামলায় গ্রেফতার দেখিয়ে রাতে কঠোর নিরাপত্তার মধ্য দিয়ে তাকে আদালতে নেয়া নেয়া হয়। 

জানা গেছে, খায়রুল হকের  বিরুদ্ধে রাজধানীর যাত্রাবাড়ী ও নারায়ণগঞ্জে মোট তিনটি মামলা রয়েছে। এরমধ্যে ১৮ জুলাই যাত্রাবাড়ীতে যুবদল কর্মী আবদুল কাইয়ুম আহাদ হত্যা মামলায় গ্রেফতার দেখানো হয়েছে তাকে। ডিবির যুগ্ম কমিশনার মোহাম্মদ নাসিরুল ইসলাম এ তথ্য নিশ্চিত করেন। জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তাকে রিমান্ডে নেয়ার আবেদন জানানো হবে বলে গোয়েন্দা পুলিশের একটি সূত্র জানায়। 

এদিকে সম্প্রতি সাবেক প্রধান বিচারপতি খায়রুল হককে গ্রেফতার ও বিচার দাবিতে সংবাদ সম্মেলন করে জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরাম। দেশের ‘বিচার বিভাগ ও গণতন্ত্র ধ্বংসের মূল কারিগর’ উল্লেখ করে তাকে বিচারের মুখোমুখি করার দাবি জানায় সংগঠনটি। বিচারাঙ্গনে তুমুলভাবে আলোচিত-সমালোচিত এ বিচারপতির বেশ কয়েকটি রায় চরম বিতর্ক সৃষ্টি করেছিল। তিনি নিজে আওয়ামী আমলে নানাভাবে সুবিধাপ্রাপ্ত হয়েছেন। তাকে প্রধান বিচারপতি করা হয়েছিল কয়েকজন জ্যেষ্ঠ বিচারপতিকে ডিঙিয়ে। গত বছরের ২৫ আগস্ট জেলা আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি ও ফতুল্লা থানা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক আবদুল বারী ভূঁইয়া বাদী হয়ে মামলাটি করেন। এ ছাড়া ঢাকাতেও মামলা রয়েছে। দেশের ১৯তম প্রধান বিচারপতি হিসেবে ২০১০ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর নিয়োগ পান খায়রুল হক। একই বছরের ৩০ সেপ্টেম্বর থেকে তাঁর নিয়োগ কার্যকর হয়। পরের বছরের ১৭ মে তিনি অবসরে যান।

খায়রুল হকের যত অপকর্ম: ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত বছরের ৫ আগস্ট প্রধানমন্ত্রী পদ থেকে পদত্যাগ করে দেশ ছেড়ে ভারতে পালিয়ে যান শেখ হাসিনা। এরপরই আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী ও হাসিনার আশীর্বাদ পুষ্ট অনেক আমলাও দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান। আবার অনেকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে গ্রেফতার হন। তবে বহুল আলোচিত সাবেক প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হকের অবস্থান নিয়ে ধোঁয়াশা ছিল। গ্রেফতারের আগে কেউ বলছিলেন, রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর অবৈধভাবে ভারতে গেছেন। সেখানেই নিরাপদে আছেন দেশের বিচারব্যবস্থা ও গণতন্ত্র ধ্বংসের এই কারিগর। কেউ বলছেন, ভারত থেকে তিনি ব্রিটিশ পাসপোর্ট ব্যবহার করে ইংল্যান্ডে গেছেন। সেখানে মেয়ের কাছে অবস্থান করছেন। আবার অনেকে বলছেন, স্বাস্থ্যগত কারণে তিনি কোথাও ট্রাভেল করছেন না। দেশেই অবস্থান করছেন তিনি। গতকাল গ্রেফতারের পর নিশ্চিত হলো-এতদিন দেশেই লুকিয়ে ছিলেন তিনি। 

আওয়ামী লীগ সরকারের শেষ সময়ে খায়রুল হক ছিলেন আইন কমিশনের চেয়ারম্যান। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত বছরের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের পতন ঘটলে ১৩ আগস্ট তিনি আইন কমিশন থেকে পদত্যাগ করেন। এরপর তাকে আর প্রকাশ্যে দেখা যায়নি। বিচারাঙ্গনে তুমুলভাবে আলোচিত-সমালোচিত এই বিচারপতির বেশ কয়েকটি রায় চরম বিতর্ক সৃষ্টি করেছিল। তিনি নিজে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে নানাভাবে সুবিধাপ্রাপ্ত হয়েছেন। তাকে প্রধান বিচারপতি করা হয়েছিল কয়েকজন জ্যেষ্ঠ বিচারপতিকে ডিঙিয়ে। প্রধান বিচারপতি থাকাকালে ত্রাণ তহবিলের টাকা গ্রহণ করে নিজের চিকিৎসা করে সমালোচিত হয়েছিলেন। অবসর গ্রহণ করার কয়েকদিন আগে তিনি ত্রয়োদশ সংশোধনী মামলায় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করেন। এতে দেশে রাজনৈতিক সংঘাতের পথ উন্মুক্ত হয়। পাশাপাশি শেখ হাসিনার ভোট ডাকাতির চূড়ান্ত সুযোগ তৈরি হয়। রাজনৈতিক একটি বিষয়কে আদালতের আওতাধীন করে শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান স্বাধীনতার ঘোষক নন বলে রায় দিয়েছিলেন তিনি।

এছাড়া বিতর্কিত একাধিক বিচারপতিকে শপথ পড়ানো, আগাম জামিনের এখতিয়ার কেড়ে নেওয়া, খালেদা জিয়াকে ক্যান্টনমেন্টের বাড়ি থেকে উচ্ছেদ করা এবং ক্ষমতার অপব্যবহারসহ নানা অভিযোগ তার বিরুদ্ধে। খায়রুল হকের বিরুদ্ধে ইতোমধ্যেই বেশ কয়েকটি মামলা হয়েছে। শেখ হাসিনা সরকার পতনের পর গত ১৮ আগস্ট ঢাকা আইনজীবী সমিতির সদস্য ইমরুল হাসান বাদী হয়ে তার বিরুদ্ধে মামলা করেন। মামলায় খায়রুল হকের বিরুদ্ধে সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিলের রায় পরিবর্তন এবং জালিয়াতির অভিযোগ আনা হয়। ২৮ আগস্ট দুর্নীতি ও রায় জালিয়াতির অভিযোগে তার বিরুদ্ধে শাহবাগ থানায় মামলা করেন আরেক আইনজীবী। এর আগে ২৫ আগস্ট খায়রুল হকের বিরুদ্ধে একই বিষয়ে নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লা থানায় আরেকটি মামলা হয়। দেশের ১৯-তম প্রধান বিচারপতি হিসেবে এবিএম খায়রুল হক শপথ নেন ২০১০ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর। পরের বছর (২০১১ সাল) ১৭ মে ৬৭ বছর পূর্ণ হওয়ায় তিনি অবসর গ্রহণ করেন।  

প্লট বরাদ্দে অনিয়মের অনুসন্ধানে দুদক: এ বি এম খায়রুল হকের বিরুদ্ধে বিধি বহির্ভূতভাবে প্লট নেওয়ার অভিযোগ অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এই অনুসন্ধানের জন্য সংস্থাটি নথিপত্র তলব করেছে। গতকাল বৃহস্পতিবার দুদকের উপপরিচালক (মিডিয়া) আকতারুল ইসলাম এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) এবং গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের যোগসাজশে সাবেক প্রধান বিচারপতি এই সুবিধা নিয়েছেন বলে অভিযোগ করা হয়েছে। অনুসন্ধানের জন্য বৃহস্পতিবারই গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সচিবকে জরুরি ভিত্তিতে প্রয়োজনীয় রেকর্ডপত্র সরবরাহের অনুরোধ জানিয়ে চিঠি পাঠানো হয়েছে। বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ২০০৩ সালে পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্পে বিচারপতি খায়রুল হককে একটি ১০ কাঠার প্লট বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল। 

তবে প্লট বরাদ্দের শর্ত অনুযায়ী প্রথম কিস্তির সাড়ে ছয় লাখ টাকা পরিশোধ না করায় রাজউক বরাদ্দ বাতিল করে। পরবর্তীতে ২০০৯ সালে তিনি সংশ্লিষ্ট অধিদপ্তর ও মন্ত্রণালয়ের অসাধু কর্মকর্তাদের যোগসাজশে আইন ও বিধি বহির্ভূতভাবে আবার প্লট গ্রহণ করেন। অভিযোগ অনুযায়ী, এ সময় তিনি ছয় বছর আগের প্রথম কিস্তির টাকার চেক জমা দেন, যা নগদায়ন হয়নি। এরপর অবসর গ্রহণের পর যাবতীয় পাওনা পরিশোধের শর্তে তাকে অবৈধভাবে প্লটটি হস্তান্তর করা হয়। দুদক জানিয়েছে, বিদ্যমান নিয়ম-নীতি লঙ্ঘন করে এককভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়ার অভিযোগের পুঙ্খানুপুঙ্খ তদন্তের মাধ্যমে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। দুদকের উপপরিচালক মো. মনিরুল ইসলামের নেতৃত্বে সাত সদস্যের একটি দল এই অনুসন্ধানের দায়িত্ব পেয়েছে।