আদালতের কাঠগড়ায় চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিলেন সাবেক সংসদ সদস্য হাজি সেলিম। কথা বলার জন্য কাঠগড়ার কাছে যান তাঁর আইনজীবী প্রাণ নাথ রায়। আইনজীবী হাজি সেলিমকে ওকালতনামায় স্বাক্ষর দিতে অনুরোধ করেন। আইনজীবীর এ কথা শুনে ক্ষেপে যান হাজি সেলিম। তিনি রাগান্বিত স্বরে চিৎকার-চেঁচামেচি করতে থাকেন। তাঁর চিৎকার শুনে এজলাসে উপস্থিত অন্যরা হতবাক হয়ে যান।
বুধবার ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) আদালতে এ ঘটনা ঘটে। আজ বিভিন্ন হত্যা মামলায় হাজি সেলিমসহ ১০ জনকে গ্রেপ্তার দেখানোর আদেশ দিয়েছেন আদালত।
অন্য আসামিরা হলেন আওয়ামী লীগের নেতা ও সাবেক মন্ত্রী আমির হোসেন আমু, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বেসরকারি বিনিয়োগ ও শিল্পবিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান, সাবেক শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি, বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন, সাবেক উপমন্ত্রী আবদুল্লাহ আল ইসলাম জ্যাকব, সাবেক সংসদ সদস্য সাদেক খান, পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন, এ কে এম শহিদুল হক ও অভিনেত্রী শমী কায়সার।
ঘড়ির কাটায় আজ সকাল ১০টা ১ মিনিট। আমুকে তখন সিএমএম আদালতের হাজতখানা থেকে বের করে আনা হয়। তাঁর দুই বাহু দুজন পুলিশ সদস্য ধরে রেখেছেন। তাঁর দুই হাত পেছনে। পরানো হাতকড়া।
আমুর সামনে ছিলেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বেসরকারি বিনিয়োগ ও শিল্পবিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান। তাঁরও দুই হাত পেছনে, পরানো হাতকড়া।
আমু ও সালমানকে হাঁটিয়ে সিএমএম আদালতের প্রধান ফটকের কাছে আনা হয়। সালমান মাথা নিচু করে সিঁড়ি দিয়ে হেঁটে আদালত ভবনের দুই তলায় ওঠেন।
তবে আমু যখন ওপরে উঠতে যাচ্ছিলেন, তখন সমস্যায় পড়ে যান। কারণ, তাঁর দুই হাত পেছনে নিয়ে হাতকড়া পরানো থাকায় তিনি ওপরের দিকে উঠতে পারছিলেন না। এ সময় দুজন পুলিশ সদস্য আমুর দুই বাহু ধরে সিঁড়ি দিয়ে দুই তলায় ওঠান। তখন আমু হাঁপাতে থাকেন।
আদালতের কাঠগড়ায় তোলার পর একজন পুলিশ সদস্য আমুর দুই হাত পেছনে নিয়ে পরিয়ে দেওয়া হাতকড়া খুলে দেন। তাঁর একহাতে পরিয়ে দেওয়া হয় হাতকড়া।
বিচারক এজলাসে প্রবেশ করেন সকাল ১০টা ৯ মিনিটে।
শুনানি শুরু হওয়ার পর আমুর একজন আইনজীবী আদালতের নজরে আনেন যে, তাঁর মক্কেল দাঁড়িয়ে থাকতে পারছেন না। তাঁকে যেন বসার অনুমতি দেওয়া হয়। একটা টুল কিংবা চেয়ার যেন তাঁর জন্য দেওয়া হয়।
একপর্যায়ে আদালত অনুমতি দেন। আদালতের কর্মচারীরা একটি চেয়ার কাঠগড়ায় দেন। তখন আমু চেয়ারটিতে বসে শুনানিতে অংশ নেন।
শুনানি নিয়ে আমুসহ অন্য আসামিদের বিভিন্ন হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়। পরে তাঁদের আদালতের হাজতখানায় নিয়ে যাওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়।
তখন দেখা যায়, কাঠগড়ায় আমুর দুই হাত পেছনে নিয়ে পরিয়ে দেওয়া হয় হাতকড়া। এবারও তিনি দুই তলা থেকে সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামার সময় দুজন পুলিশ সদস্যের সহযোগিতা নেন। অন্য আসামিরা হাজতখানায় ঢুকে যান। সবার শেষে হাজতখানায় প্রবেশ করেন আমু।
গত বছরের ৬ নভেম্বর আমু গ্রেপ্তার হওয়ার পর বেশ কয়েকবার তাঁকে কারাগার থেকে আদালতে আনা হয়েছে। তবে আজই প্রথম তাঁর দুই হাত পেছনে নিয়ে হাতকড়া পরিয়ে দেয় পুলিশ।
সাত মাসের বেশি সময় ধরে কারাগারে আছেন আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক মন্ত্রী দীপু মনি। আর পাঁচ মাসের বেশি সময় ধরে কারাগারে আছেন অভিনেত্রী শমী কায়সার। দুজনই এখন কাশিমপুর কারাগারে রয়েছেন।
একটি প্রিজন ভ্যানে করে দীপু মনিকে কাশিমপুর কারাগার থেকে আজ সকাল সাড়ে ৮টার দিকে ঢাকার সিএমএম আদালতের হাজতখানায় আনা হয়। অন্যদিকে শমী কায়সারকে সাধারণ নারী কয়েদিদের সঙ্গে সকাল সাড়ে ৮টার পর প্রিজন ভ্যানে করে আদালতের হাজতখানায় এনে রাখা হয়।
সকাল ১০টার পর সালমান এফ রহমান, রাশেদ খান মেনন, আমির হোসেন আমুদের সঙ্গে দীপু মনি ও শমী কায়সারকে হাজতখানা থেকে আদালতের এজলাস কক্ষে তোলা হয়। আদালতে তোলার সময় তাঁদের (দীপু মনি ও শমী কায়সার) মাথায় হেলমেট পরানো হয়। গায়ে পরানো হয় বুলেট প্রুফ জ্যাকেট।
ঘড়ির কাঁটায় তখন সকাল ১০টা ১৫ মিনিট। দীপু মনি কাঠগড়ার সামনের দিকে দাঁড়িয়ে ছিলেন। তাঁর বাম পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন সালমান এফ রহমান। আর পেছনে দাঁড়িয়ে ছিলেন শমী কায়সার। তিনি বিমর্ষ মুখে কথা বলতে থাকেন সাবেক উপমন্ত্রী আবদুল্লাহ আল ইসলাম জ্যাকবের সঙ্গে। প্রায় দুই মিনিট ধরে তাঁরা কথা বলেন।
একপর্যায়ে শমী কায়সারের কাছে এগিয়ে যান দীপু মনি। তখন শমী কায়সারকে আরও বিমর্ষ দেখা যায়। পরে শমী কায়সার কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে থাকা সাবেক আইজিপি শহিদুল হকের সঙ্গে কথা বলেন।
একই কাঠগড়ায় তখন দাঁড়িয়ে ছিলেন রাশেদ খান মেনন ও চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন।
আদালতে দেখা যায়, কাঠগড়ায় যখন শমী কায়সার ও দীপু মনি দাঁড়িয়ে ছিলেন, তখন দুই থেকে তিনজন নারী পুলিশ কনস্টেবল তাঁদের পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন।
একই কাঠগড়ায় নারী ও পুরুষ আসামি রাখার বিষয়ে ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতের প্রধান পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) ওমর ফারুক ফারুকী প্রথম আলোকে বলেন, ‘আদালতে যে কাঠগড়া রয়েছে, যেখানে আসামিদের দাঁড়িয়ে রাখা হয়। কাঠগড়ায় পর্যাপ্ত জাগা রয়েছে। কোনো নারী যখন আসামি হিসেবে আদালত কক্ষে আসেন, তখন তাঁদের কাঠগড়ার একপাশে দাঁড় করিয়ে রাখা হয়। একটা গ্যাপ (দূরত্ব) সেখানে রাখা হয়। সেখানেই পুরুষ আসামিরা দাঁড়িয়ে থাকেন।’
পিপি ওমর ফারুক ফারুকী প্রথম আলোকে আরও বলেন, নারী আসামিদের নারী পুলিশ কনস্টেবল দিয়ে আদালতে তোলা হয়।
কাঠগড়ায় সালমান এফ রহমানকে দেখে হাত উঁচু করে সালাম দেন সাবেক শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি। সালাম গ্রহণ করেন সালমান এফ রহমান। পরে তিনি দীপু মনির সঙ্গে কুশল বিনিময় করেন।
তখন কাঠগড়ায় নিশ্চুপ পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন হাজি সেলিম। হাজি সেলিমের সঙ্গে কথা বলার জন্য কাঠগড়ার কাছে যান তাঁর আইনজীবী প্রাণ নাথ রায়। আইনজীবী তখন হাজি সেলিমকে ওকালতনামায় স্বাক্ষর দেওয়ার জন্য অনুরোধ করেন। আইনজীবীর এ কথা শুনে ক্ষেপে ওঠেন হাজি সেলিম। অসুস্থতাজনিত কারণে তাঁর কথা বলার ক্ষেত্রে সমস্যা আছে। তিনি রাগান্বিত স্বরে চিৎকার–চেঁচামেচি করতে থাকেন।
হাজি সেলিমের চিৎকার শুনে এজলাসে উপস্থিত অন্যরা হতবাক হয়ে যান। হাজি সেলিমের মেজাজ হারানোর বিষয় তাঁর আইনজীবীর সঙ্গে এ সময় কথা বলেন কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে থাকা সাবেক সংসদ সদস্য সাদেক খান।
সাদেক খান তখন আইনজীবী প্রাণ নাথ রায়কে উদ্দেশ্যে বলেন, কারাগারে সমস্যায় রয়েছেন হাজি সেলিম। হাজি সেলিমের কথা কারাগারে কেউ বোঝেন না। খাওয়া-দাওয়ায় সমস্যা হচ্ছে।