আর্কাইভ | ঢাকা, শনিবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৫, ৬ বৈশাখ ১৪৩২, ১৯ শা‍ওয়াল ১৪৪৬ ০৭:২৮:১৩ পূর্বাহ্ন
Photo
বিশেষ প্রতিবেদক
ঢাকা, প্রকাশিতঃ
০৭ ফেব্রুয়ারী ২০২৫
১২:৪৭:৪৩ অপরাহ্ন

সংবিধানকে গণতান্ত্রিক ডকুমেন্টে পরিণত করা আমাদের লক্ষ্য : আলী রীয়াজ


যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতি ও সরকার বিভাগের অধ্যাপক এবং আটলান্টিক কাউন্সিলের অনাবাসিক সিনিয়র ফেলো ও আমেরিকান ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ স্টাডিজের সভাপতি আলী রীয়াজ রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও লেখক। বর্তমানে তিনি বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার কর্তৃক গঠিত সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রধান হিসাবে দায়িত্ব পালন করছেন। সম্প্রতি এ কমিশন তাদের সুপারিশ জমা দিয়েছে

প্রধান উপদেষ্টার কাছে। সংবিধান, রাষ্ট্র এবং রাজনীতি নিয়ে তার সঙ্গে কথা বলেছেন জুননু রাইন

সংবিধান সংস্কারকাজে আপনাদের কাজের ধাপগুলো কেমন ছিল?

আমরা দুভাগে কাজটি করছি। একটি পর্যালোচনা, অন্যটি সুপারিশমালা তৈরি। পর্যালোচনায় নিজেদের সংবিধান ছাড়া আরও ১২০টি দেশের সংবিধান আমাদের গবেষণা টিম পর্যবেক্ষণ করেছে। এর মাধ্যমে বিগত ৫২ বছরে আমাদের সংবিধানের দুর্বল ও সবল দিকগুলো খুঁজে বের করার চেষ্টা আমরা করেছি। অংশীজনদের কাছ থেকে সংগৃহীত মত এবং কমিশনের সব সদস্যের মত একত্রিত করে সুপারিশ তৈরি করা হয়েছে। জনমতকে প্রাধান্য দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোকে সুপারিশমালায় অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে। আমাদের লক্ষ্য সংবিধানকে গণতান্ত্রিক ডকুমেন্টে পরিণত করা, তার যথাযথ সুরক্ষা নিশ্চিত করা, ক্ষমতা যাতে এককেন্দ্রীকরণ না হতে পারে-সেসব বিষয়ে সরকারকে পরামর্শ দেওয়া। আমাদের সুপারিশে কোনো সময় নির্ধারণ করে দেওয়া হয়নি। সরকার সেগুলোকে একসঙ্গে নাকি পর্যায়ক্রমে-কোন প্রক্রিয়ায় বাস্তবায়ন করবে, সেটা তারা নির্ধারণ করবে।

সংবিধান বারবার পরিবর্তন করা কতটা যৌক্তিক?

: কোনো সংবিধান পারফেক্ট নয়, এটা কোনো ঐশী বাণী নয়, এটা জনগণের আকাঙ্ক্ষার ফসল, রাষ্ট্রের জন্য দিকনির্দেশনা। রাষ্ট্র ও জন-আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে তা পরিবর্তন হতেই পারে। এক-তৃতীয়াংশ সংবিধান আপনি বদলাতে দেবেন না-এটা নৈতিক, আইনি, রাজনৈতিক কোনো দিক থেকেই সেটা গ্রহণযোগ্য নয়। আর সেটাই করা হয়েছে পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে। কাঠামোগত ও মর্মবস্তুর দিক থেকে আমি মনে করি, এ দেশের সংবিধান দুবার পুনর্লিখন হয়েছে। তার একটি হলো ১৯৭৫ সালে শেখ মুজিবুর রহমানের আমলে চতুর্থ সংশোধনী, যা ছিল সবচেয়ে ভয়াবহ। অপরটি ২০১১ সালে পঞ্চদশ সংশোধনী। পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে দেশের খোলনলচে পালটে দেওয়া হয়েছে। বলা যায়, ওই দুটি সংশোধনীর মাধ্যমে দীর্ঘ মেয়াদে একদলীয় শাসনব্যবস্থা ও জনগণের মৌলিক অধিকার খর্ব করা হয়েছে, যা এ দেশের মানুষ গ্রহণ করেনি।

যে কোনো দেশের সংবিধান হচ্ছে তার একটা রাজনৈতিক দলিল। সে অর্থে স্বাধীনতার সময় বাংলাদেশের স্বাধীনতার যে ঘোষণাপত্র, সেটাকে আপনি প্রথম সংবিধান হিসাবে বিবেচনা করতে পারেন। কারণ, সেটা পথনির্দেশক ছিল, রাষ্ট্র কীভাবে পরিচালিত হবে, এর একটা দিকনির্দেশনা ছিল। আমাদের সাম্য, মানবিক মর্যাদা এবং সামাজিক সুবিচারের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল; সেই অর্থে এটা ছিল একটা দিকনির্দেশনা। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৭২ সালে একটা সংবিধান প্রণীত হয়। এটাকে আমরা সাধারণ কথায় প্রথম সংবিধান বলি, আরও অর্থে দ্বিতীয় সংবিধানও বলা যায়। এটাও একটা রাজনৈতিক দিকনির্দেশনা দিয়েছে; নাগরিকদের অধিকার কী হবে, প্রতিষ্ঠানগুলো কীভাবে কাজ করবে, এর একটা দিকনির্দেশনা আমরা পাই। সে প্রতিশ্রুতিগুলোয় কিছু কিছু কার্যকর পদ্ধতির কথা ছিল, প্রতিষ্ঠানগুলোর চরিত্রের কথা ছিল-এটা নিঃসন্দেহে একটা অর্জন। কিন্তু তার কিছু ত্রুটিও ছিল। তবে একটা বড় সাফল্যের দিক হলো-অত্যন্ত স্বল্পসময়ে একটা সংবিধান তৈরি করা হয়েছিল। অন্যান্য দেশের অভিজ্ঞতা, বিষেশত একটা যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ বিবেচনায় এটা নিঃসন্দেহে একটা সাফল্য। 

আর দুর্বলতার জায়গাগুলো হলো-নাগরিকের অধিকার সুনিশ্চিত করা গেল না। প্রতিষ্ঠানগুলোর স্বাভাবিক যে স্বাধীনতা থাকার কথা ছিল, যেমন বিচার বিভাগের কথাই যদি ধরি, সেটা থাকল না। সেই প্রতিশ্রুতি থাকল না। প্রধানমন্ত্রী আইনসভা থেকে এসেছেন; কিন্তু তিনি তো নির্বাহী বিভাগের প্রধান; তাকে অপসারণেরও কোনো পথ থাকল না, জবাবদিহির কোনো জায়গা থাকল না। ফলে অনেক কিছুর প্রতিশ্রুতি থাকল; কিছু কিছু প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন হলো, কিন্তু অনেক বেশি দুর্বলতাও থেকে গেল। তাহলে সেই সংবিধান আমাদের কী দিয়েছে? একটা দিকনির্দেশনা দিয়েছে। একটা স্বাধীন সত্তা হিসাবে বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠার ঘোষণাটা ওর মধ্যেই আছে; যে আমরা স্বাধীন, আমাদের স্বাধীন সার্বভৌমত্ব আছে এবং আমরা আমাদের অধিকারগুলো প্রতিষ্ঠার জন্য প্রতিষ্ঠান তৈরি করতে চেষ্টা করছি।

৫৪ বছরের বাংলাদেশে অনেকবারই সংবিধানের সংশোধনী হয়েছে। এ থেকে সাধরণ মানুষ কতটুকু সুফল পেয়েছে বলে আপনার মনে হয়?

তথ্যসূত্র : দৈনিক যুগান্তর।