নিরাপত্তা বাহিনীর নির্যাতনে কুমিল্লায় যুবদল নেতা তৌহিদুল ইসলামের (৪০) মৃত্যুর অভিযোগের বিষয়ে জরুরি তদন্তের নির্দেশ দিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। এদিকে মৃত্যুর ঘটনায় সংশ্লিষ্ট ক্যাম্পের কমান্ডারকে প্রত্যাহার করেছে সেনাবাহিনী, গঠন করা হয়েছে উচ্চপদস্থ তদন্ত কমিটি। এ ঘটনায় মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) উদ্বেগ জানিয়ে নিরপেক্ষ তদন্তের দাবি জানিয়েছে। এছাড়া প্রতিবাদ জানিয়ে মানববন্ধন করেছে গ্রামবাসী।
শনিবার প্রধান উপদেষ্টার ডেপুটি প্রেস সেক্রেটারি আবুল কালাম আজাদ মজুমদার এক বিবৃতিতে জানান, শুক্রবার ভোরে অভিযোগের ভিত্তিতে বাড়ি থেকে আটক করার পর নিরাপত্তা বাহিনীর নির্যাতনে আহত অবস্থায় গভীর রাতে তৌহিদুল ইসলামকে হাসপাতালে নেওয়া হয়। বিবৃতিতে বলা হয়, অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার যে কোনো ধরনের হেফাজতে নির্যাতন ও হত্যাকাণ্ডের কঠোর নিন্দা জানায়। জাতীয় জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে মানবাধিকার রক্ষা সরকারের অন্যতম প্রধান লক্ষ্য, যেখানে দেশের শীর্ষস্থানীয় মানবাধিকার কর্মীরাও যুক্ত। বিবৃতিতে বলা হয়, দেশের ফৌজদারি বিচারব্যবস্থার সংস্কারের জন্য সরকার বেশ কয়েকটি কমিশন গঠন করেছে, যার মধ্যে অধিকাংশই তাদের প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। অর্ন্তবর্তী সরকার পুলিশি জিজ্ঞাসাবাদ, অপরাধ ব্যবস্থাপনা এবং বিচার প্রক্রিয়ায় মানবাধিকার লঙ্ঘনের সুযোগ সম্পূর্ণরূপে দূর করতে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে অর্থবহ সংলাপ চালিয়ে যাবে। সংস্কার বাস্তবায়নে সরকার অঙ্গীকারবদ্ধ বলে বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়।
এদিকে আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তরের (আইএসপিআর) জানিয়েছে, তৌহিদুল ইসলামের মৃত্যুর সঠিক কারণ উদঘাটনের জন্য একটি উচ্চপদস্থ তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। শনিবার দুপুরে আইএসপিআর থেকে পাঠানো এক বিজ্ঞপ্তিতে এসব তথ্য জানানো হয়। আইএসপিআর জানায়, গত ৩১ জানুয়ারি সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে যৌথবাহিনীর অভিযানে কুমিল্লার আদর্শ সদর উপজেলা থেকে আটক মো. তৌহিদুর রহমানকে আটক করা হয়। পরে কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। এই অনাকাঙ্খিত ও দুঃখজনক ঘটনাটি তদন্তে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। আইএসপিআর আরও জানায়, ইতোমধ্যে ওই সেনা ক্যাম্পের ক্যাম্প কমান্ডারকে তাৎক্ষণিকভাবে প্রত্যাহার করা হয়েছে। এছাড়াও, মৃত্যুর সঠিক কারণ উদঘাটনের জন্য একটি উচ্চপদস্থ তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। তদন্তে দোষী সাব্যস্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে সেনা আইন অনুযায়ী যথাযথ আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে বলেও জানিয়েছে আইএসপিআর।
গ্রামবাসীর মানববন্ধন: সকাল ১০টার দিকে ইটাল্লা গ্রামের সড়কের ওপর লাশবাহী গাড়ি রেখে মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করেন শত শত মানুষ। ওই যুবদল নেতাকে তুলে নিয়ে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছে দাবি করেন এলাকাবাসী। চার মেয়েকে নিয়ে কর্মসূচিতে অংশ নেন তৌহিদুলের স্ত্রীও। তারা লাশবাহী গাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন। পরে দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে কুমিল্লা প্রেসক্লাবের সামনে লাশবাহী গাড়ি সামনে নিয়ে আরেকটি মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করা হয়েছে। দুপুর ১টা পর্যন্ত চলা এই মানববন্ধনে তৌহিদুলের পরিবারের সদস্যরাসহ গ্রামবাসী অংশ নেন। স্থানীয় বিক্ষুব্ধ ব্যক্তিরা গতকাল দুপুরে মানববন্ধন ও বিক্ষোভ মিছিল করে। সকাল দশটার দিকে ইটাল্লা গ্রামের লাশবাহী গাড়ী নিয়েই মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করে গ্রামবাসী। পরে দুপুর বারটার দিকে কুমিল্লা প্রেসক্লাবের সামনে আরেকটি মানববন্ধনে তার পরিবার ও এলাকাবাসী অংশ নেয়। সেই কর্মসূচিতে অংশ নেয়া তৌহিদুল ইসলামের চাচাতো ভাই আনোয়ার হোসেন জানান ঘটনাটি নিয়ে এলাকায় তীব্র প্রতিক্রিয়া হওয়ার পর সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে পরিবারের সাথে যোগাযোগ করে দায়ীদের সেনা আইনে বিচারের কথা জানিয়েছে। এছাড়া স্থানীয় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের একজন সমন্বয়কের মাধ্যমেও নিহতের পরিবার ও এলাকাবাসীকে ঘটনার বিচারের আশ্বাস দেয়া হয়েছে বলে তিনি জানান।
মানববন্ধনে কান্নাজড়িত কণ্ঠে ইয়াসমিন নাহার বলেন, বিনা অপরাধে আমার স্বামীকে সেনাবাহিনী তুলে নিয়ে যায়। এরপর অমানবিক নির্যাতন করে আমার স্বামীকে হত্যা করা হয়েছে। আমি স্বামী হত্যার বিচার চাই। আমার অবুঝ মেয়েগুলোকে যারা এতিম করেছে, তাদের বিচার চাই। আইন যদি সবার জন্য সমান হয়, তাহলে আমরা কেন বিচার পাব না? বাবাকে হারিয়ে তৌহিদুলের বড় মেয়ে তাসফিয়া আক্তারের কান্না থামছেই না। তাসফিয়া বলেন, আমরা এখন কাকে বাবা বলে ডাকব। আমার বাবা অনেক ভালো মানুষ ছিলেন। আমার ভালো বাবাটাকে নির্যাতন করে হত্যা করা হয়েছে। আমরা চার বোন এতিম হয়ে গেছি। আমরা বাবার হত্যাকারীদের বিচার চাই। মানববন্ধনে স্থানীয় বাসিন্দা ফজলুর রহমান বলেন, একজন ভালো মানুষকে তারা তুলে নিয়ে হত্যা করল। আমরা বিষয়টি কিছুতেই মেনে নিতে পারছি না। আমরা এই ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার চাই।
যুবদল নেতা তৌহিদুল ইসলামের বাড়িতে একনো কান্নার রোল। কুমিল্লা মেডিকেল কলেজের মর্গে ময়নাতদন্ত শেষে শুক্রবার রাত আটটার দিকে স্বজনেরা তৌহিদুলের লাশ বাড়িতে নিয়ে আসেন। শনিবার দুপুরে জানাজা শেষে তাকে পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করার কথা রয়েছে। মাত্র ছয় দিন আগে (২৬ জানুয়ারি) তৌহিদুলের বাবা মোখলেছুর রহমান (৮৫) বার্ধক্যের কারণে মারা যান। তার কুলখানির আয়োজন করা হয়েছিল শুক্রবার। সেটি শেষ পর্যন্ত আর হয়নি। তৌহিদুলের মৃত্যুতে এলোমেলো হয়ে গেছে সবকিছু। তৌহিদুলের মৃত্যুর ঘটনায় দুপুরে এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত থানায় কোনো মামলা হয়নি। তার শরীরে নির্যাতনের ক্ষতচিহ্ন থাকার কথা জানিয়েছেন চিকিৎসক ও স্বজনেরা। তবে বিষয়টি নিয়ে কারও কোনো অভিযোগ নেই বলে দাবি করেছেন কুমিল্লা কোতোয়ালি মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. মহিনুল ইসলাম। তিনি জানিয়েছেন, তৌহিদুলের মৃত্যু নিয়ে পরিবারের কোনো অভিযোগ নেই। আমরা একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করে লাশের সুরতহাল প্রতিবেদন তৈরি এবং ময়নাতদন্ত শেষে লাশ হস্তান্তর করেছি। তবে ভিন্ন কথা বলছেন ওই যুবদল নেতার পরিবার ও স্বজনেরা। সকালে তৌহিদুলের ভগ্নিপতি সোহেল মহিউদ্দিন গণমাধ্যমকে বলেন, কতটা অমানবিক নির্যাতন করে তৌহিদুলকে মেরে ফেলা হয়, তা ভাষায় প্রকাশ করে শেষ করা যাবে না। তার বিরুদ্ধে মামলা তো দূরের কথা, একটি জিডিও ছিল না। আমরা এ ঘটনায় অবশ্যই মামলা করব। থানায় মামলা না নিলে আদালতে যাব। তৌহিদুলের চারটি মেয়ে এতিম হয়ে গেল।
যে কারণে ঘটনা: স্থানীয় কয়েকজন জানিয়েছেন ইটাল্লা এলাকায় তাদের পৈত্রিক সম্পদ নিয়ে অনেকদিন ধরেই বিরোধ চলছিলো। বুধবার আরও কয়েকজনকে নিয়ে তৌহিদুল ইসলাম সেখানে গিয়েছিলেন। তাদের দাবি, এ ঘটনার পর একটি পক্ষ সেনাক্যাম্পে অভিযোগ করার পর যৌথবাহিনী অভিযান চালায়। এরপরই তাকে আটক করে বিভিন্ন জায়গায় রাতেই অস্ত্র উদ্ধারের অভিযান চালানো হয়। সম্ভবত ওই সময় জিজ্ঞাসাবাদের সময় করা নির্যাতনের কারণেই তিনি প্রাণ হারিয়েছেন, নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ করে বলেছেন স্থানীয় এক ব্যক্তি।
তবে তৌহিদুল ইসলামের ভাই আবুল কালাম আজাদ বলেছেন সেনা সদস্যরা তাদের ঘর তল্লাশির সময় বারবার জিজ্ঞেস করেছে অস্ত্র কোথায়। তারা অস্ত্র খুঁজছিলো। তাদের সাথে চার জন সিভিল লোক ছিলো। এক পর্যায়ে আমার ভাইকে নিয়ে যায়। সেনাবাহিনীর বাইরে বেসামরিক যারা জড়িত, যারা সেনাবাহিনীকে মিথ্যা তথ্য দিয়েছে তাদেরও খুঁজে বের করতে হবে। নিহত তৌহিদুল ইসলামের বড় ভাই আবুল কালাম আজাদ জানান, যৌথবাহিনীর পক্ষ থেকে কুমিল্লায় তাদের পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করে 'ঘটনার জন্য দায়ীদের' সেনা আইনে বিচারের অঙ্গীকার করা হয়েছে। ঘটনার প্রতিবাদে স্থানীয়রা শনিবার দুপুরে বিক্ষোভ মিছিল ও মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করেছে। সামাজিক মাধ্যমেও এ ঘটনা নিয়ে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। অনেকে একে 'বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড' উল্লেখ করে দায়ীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চেয়েছেন। কুমিল্লার পুলিশ সুপার মোহাম্মাদ নাজির আহমেদ খাঁন বিবিসি বাংলাকে জানিয়েছেন নিহত তৌহিদুল ইসলামকে শুক্রবার পুলিশ অসুস্থ অবস্থায় পেয়েছিলো। অসুস্থ অবস্থায় পেয়ে দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে গেছি। সেখানকার চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেছেন।
এখন পোস্ট মর্টেম রিপোর্ট পেলে মৃত্যুর প্রকৃত কারণ পাওয়া যাবে। তিনি জানান শুক্রবার বেলা এগারটার দিকে যৌথ বাহিনীর পক্ষ থেকে থানা পুলিশকে জানানো হয়। এরপর পুলিশ যখন তাকে গ্রহণ করে তখন তিনি অসুস্থ ছিলেন। পুলিশের মধ্যে যারা তৌহিদুল ইসলামকে সেনাসদস্যদের হাত থেকে গ্রহণ করেন তার মধ্যে ছিলেন স্থানীয় কোতোয়ালি থানার একজন পুলিশ কর্মকর্তা মোহাম্মদ মোর্শেদ আলম। বিবিসি বাংলাকে তিনি জানিয়েছেন, সেনাসদস্যদের হাত থেকে তৌহিদুল ইসলামকে যখন নিজেদের কাছে নেন তখনো তার জ্ঞান ছিলো কিন্তু কয়েক মিনিটের মধ্যেই তিনি জ্ঞান হারান। আমরা দ্রুত তাকে কুমিল্লা সদর হাসপাতালে নেই। সাথে সাথে পরিবারের সাথে যোগাযোগ করি। সেখানকার চিকিৎসকরা তাকে দ্রুত কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেয়ার পরামর্শ দিলে সেখানেই নিয়ে যাই ও পরিবারের সদস্যদের সেখানে আসতে বলি। সেখানেই ডাক্তার তাকে মৃত ঘোষণা করেন। পরিবারের সদস্য হিসেবে সেখানে ছিলেন তার বড় ভাই আবুল কালাম আজাদ।
মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) এক বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছে, এ ধরনের ঘটনা মানবাধিকার ও আইনের শাসনের পরিপন্থি। রাষ্ট্র আটককৃত ব্যক্তির সুরক্ষা নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। এ ধরনের মৃত্যুর ঘটনা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। আসক এ ঘটনার স্বাধীন, নিরপেক্ষ ও দ্রুত বিচারিক তদন্ত এবং দায়ীদের যথাযথ আইনানুগ শাস্তির আওতায় আনার দাবি জানাচ্ছে। একইসঙ্গে নিহতের পরিবারকে ন্যায়বিচার ও ক্ষতিপূরণ দিতে যথাযথ উদ্যোগ নেওয়ার অনুরোধ জানাচ্ছে।