আর্কাইভ | ঢাকা, রবিবার, ০৫ জানুয়ারী ২০২৫, ২১ পৌষ ১৪৩১, ৪ রজব ১৪৪৬ ০৫:০৪:২৮ পূর্বাহ্ন
Photo
বিশেষ প্রতিবেদক
ঢাকা, প্রকাশিতঃ
৩০ ডিসেম্বর ২০২৪
১০:০৭:০৫ পূর্বাহ্ন

সড়কে মৃত্যুর মিছিল থামছে না  


প্রশাসনিক প্রাণকেন্দ্র সচিবালয়ে আগুন নিয়ন্ত্রণের কাজ করতে গিয়ে ট্রাকচাপায় ফায়ার ফাইটার সোয়ানুর জামান নয়নের মর্মান্তিক মৃত্যু হয়েছে। এ ঘটনার একদিন পর শুক্রবার বেলা ১১টার দিকে ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়ের ধলেশ্বরী টোল প্লাজায় দাঁড়িয়ে থাকা তিনটি গাড়িতে ধাক্কা দেয় যাত্রীবাহী একটি বাস। এতে একই পরিবারের চারজনসহ দুটি গাড়ির ছয় আরোহী নিহত হন, চারজন আহত হন। এর একদিন আগে পাবনায় ট্রাকচাপায় তিন কৃষিশ্রমিক নিহত হন। সর্বশেষ রোববার শেরপুরে যাত্রীবাহী একটি বাসের সঙ্গে সিএনজিচালিত অটোরিকশার মুখোমুখি সংঘর্ষে ৬ জন নিহত হয়েছেন। আশঙ্কাজনক অবস্থায় রয়েছেন আরও একজন। এভাবে গত চার দিনে বিভিন্ন জেলায় সড়কে ঝরেছে অন্তত ৪২ জনের প্রাণ। সড়কে মৃত্যুর মিছিল যেনো কিছুতেই থামছে না! দেশে প্রতিদিনই সড়ক দুর্ঘটনায় অগুনতি প্রাণ ঝরছে, অনেকে আহত হয়ে দুর্বিষহ জীবন কাটাচ্ছেন।

বিশেষজ্ঞরা জানান, দুর্ঘটনা রোধে সরকারের পক্ষ থেকে নানা পদক্ষেপ গ্রহণের কথা বলা হলেও বাস্তবায়ন হচ্ছে না। বেপরোয়া যান চলাচল বন্ধ হয়নি। এতে বোঝা যায়, দুর্ঘটনা রোধের পদক্ষেপগুলোয় অথবা সেসব কার্যকর করার ক্ষেত্রে নানা গলদ রয়ে গেছে সেসব দূর করা খুবই জরুরি। দেশে সড়ক দুর্ঘটনার হার অনেক উঁচু। এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, শতকরা ৮০ ভাগ সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে থাকে বিরামহীন গাড়ি চালনা, অত্যধিক গতিতে গাড়ি চালনা এবং চালকের অসাবধানতার কারণে। একজন চালক একটানা চার-পাঁচ ঘণ্টা গাড়ি চালানোর পর বিশ্রাম নিয়ে পুনরায় গাড়ি চালাবেন, এটাই নিয়ম। কিন্তু দেশের কোনো চালকই এ নিয়ম পালন করেন না। ফলে একজন ক্লান্ত-পরিশ্রান্ত চালক যখন গাড়ি চালান, তখন স্বভাবতই দুর্ঘটনার আশঙ্কা থাকে বেশি। এজন্য মূলত বাস মালিকদের অত্যধিক ব্যবসায়িক মনোভাবই দায়ী। এ প্রবণতা রোধে সরকারের কঠোর নজরদারি প্রয়োজন। কতিপয় চালক মাদক সেবন করে গাড়ি চালায়। দুর্ঘটনার আগে মাদকাসক্ত চালকদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনার নজির নেই।


এক্সপ্রেসওয়ের ধলেশ্বরী টোলপ্লাজায় প্রাইভেটকার ও মোটরসাইকেল দুমড়ে-মুচড়ে ৬ জন নিহতের ঘটনায় চাপা দেওয়া সেই বাসের চালক নুরুন্নবীসহ ২ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে দুর্ঘটনার দিন শুক্রবার রাতেই। বাসটির ফিটনেস ছিল না বলে জানিয়েছে পুলিশ। এ ব্যাপারে হাইওয়ে পুলিশের অতিরিক্ত ডিআইজি ড. আ ক ম আকতারুজ্জামান বসুনিয়া বলেন, ‘বাসটি দুর্ঘটনার আগের দিন গ্যারেজ থেকে বের করা হয়। কিন্তু ফিটনেস ছিল না। মাদকাসক্ত ও মেয়াদোত্তীর্ণ লাইসেন্সধারী চালক দিয়ে বাসটি চালানো হয়।’ এছাড়া চাপা দেওয়া সেই বাসের মালিক ডাব্লিউ ব্যাপারীকেও শনিবার রাত সাড়ে ১২টার দিকে মাদারীপুরের শিবচর থেকে তাকে গ্রেফতার করে হাইওয়ে পুলিশ। হাইওয়ে পুলিশ সূত্রে জানা যায়, বাসটি দুর্ঘটনার আগের দিন গ্যারেজ থেকে বের করা হয়। কিন্তু ফিটনেস ছিল না। এছাড়া মাদকাসক্ত ও মেয়াদোত্তীর্ণ লাইসেন্সধারী চালক দিয়ে পরিবহনটি চালানো হয়।

সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ে কাজ করা সংগঠন রোড সেফটি ফাউন্ডেশন সড়ক দুর্ঘটনার কারণ হিসেবে জানায়, ত্রুটিপূর্ণ যানবাহন, বেপরোয়া গতি, চালকদের অদক্ষতা ও শারীরিক-মানসিক অসুস্থতা, চালকদের বেতন-কর্মঘণ্টা নির্দিষ্ট না থাকা, মহাসড়কে স্বল্পগতির  যানবাহন চলাচল, বেপরোয়া মোটরসাইকেল চালানো, ট্রাফিক আইন সম্পর্কে অজ্ঞতা ও না মানা, দুর্বল ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা ও তদারকি এবং চাঁদাবাজি। সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮ সঠিক বাস্তবায়ন এবং দক্ষ চালক তৈরির পাশাপাশি ট্রাফিক আইন নিয়ে সচেতনতা গড়ে তোলার আহ্বান জানিয়েছে রোড সেফটি ফাউন্ডেশন। রোড সেফটির তথ্য অনুযায়ী, দুর্ঘটনায় সম্পৃক্ত যানবাহনে পণ্যবাহী যানের সংখ্যা বেশি। এ প্রসঙ্গে ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক সাইদুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, দেশে চালকদের কোনো নির্দিষ্ট কর্মঘণ্টা নেই। বিশেষ করে পণ্যবাহী যান যাঁরা চালান, তারা ২৪ ঘণ্টার ১৮ ঘণ্টাই থাকেন সড়কে। মানসিকভাবেও তারা অসুস্থ থাকেন। যাত্রীবাহী যানের চালকদের সঙ্গে মানুষের সংযোগ থাকে; কিন্তু পণ্যবাহী যানে চালকের শুধু একজন সহকারী থাকেন। সামাজিক ও মানসিক প্রশান্তিও তাদের থাকে না। প্রতিবেদনে বলা হয়, আঞ্চলিক সড়কে সবচেয়ে বেশি ৩৮ দশমিক ৯০ শতাংশ দুর্ঘটনা ঘটেছে। এরপর আছে ৩৩ দশমিক ৭১ শতাংশ জাতীয় মহাসড়কে এবং ১৪ শতাংশের বেশি গ্রামীণ সড়কে। শিশুমৃত্যু বেশি হওয়া প্রসঙ্গে সাইদুর রহমান বলেন, এখন ঘর থেকে বের হলেই সড়ক। সেখানে ইচ্ছেমতো থ্রি–হুইলার চলাচল করছে। শিশুরা রাস্তায় গিয়ে দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছে। এ ছাড়া স্কুলে যাওয়া-আসার পথে তারা দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছে। বিভাগের দিক দিয়ে ঢাকা বিভাগে সবচেয়ে বেশি দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি ঘটেছে। সবচেয়ে কম সিলেট বিভাগে।


২০১৮ সালে নিরাপদ সড়ক ও সারা দেশে কার্যকর সড়ক নিরাপত্তার দাবিতে ২৯ জুলাই থেকে ৮ আগস্ট ২০১৮ পর্যন্ত ব্যাপক আন্দোলন বা গণবিক্ষোভ হয়েছিল। তখন ঢাকায় ২৯ জুলাই রাজধানীর বিমানবন্দর সড়কে দ্রুতগতির দুই বাসের সংঘর্ষে রমিজ উদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের দুই শিক্ষার্থী রাজীব ও দিয়া নিহত হয় ও ১০ জন শিক্ষার্থী আহত হয়। এই সড়ক দুর্ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে নিহত দুই কলেজ শিক্ষার্থীর সহপাঠীদের মাধ্যমে শুরু হওয়া এই বিক্ষোভ পরে সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে এবং তখনকার নৌমন্ত্রীর পদত্যাগসহ ৯ দফা দাবিতে শিক্ষার্থীরা রাস্তায় নেমে আসে। বিগত বছরগুলোতে দুই বাসের চাপায় হাত হারানো রাজীব, বাসের হেলপার কর্তৃক নদীতে ফেলে দেয়া পায়েল, বাসচাপায় আহত সৈয়দ মাসুদ রানা, বিমানবন্দর সড়কে বাসচাপায় দুই কলেজ শিক্ষার্থীর মৃত্যু, নটর ডেম কলেজের মেধাবী ছাত্রের মৃত্যুর ঘটনায় জনমনে ব্যাপক সমালোচনা ও বিক্ষোভের সৃষ্টি হয়।

সড়ক নিরাপত্তা ও নিরাপদ সড়ক নিয়ে কাজ করে বাংলাদেশ যাত্রীকল্যাণ সমিতি। সংগঠনটি সড়ক দুর্ঘটনার জন্য বেপরোয়া গতিতে যানবাহন চালানোসহ ৯টি কারণ চিহ্নিত করেছে। সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছেÑ যানবাহনের বেপরোয়া গতি, ফিটনেসবিহীন যানবাহন ও পণ্যবাহী গাড়িতে যাত্রী বহন, পণ্যবাহী যানবাহন বন্ধের সিদ্ধান্ত অমান্য করা, অদক্ষ চালক ও হেলপার দিয়ে যানবাহন চালানো। সংগঠনটি দুর্ঘটনা কমিয়ে আনতেও ১২টি সুপারিশও করেছে। সুপারিশগুলোর মধ্যে রয়েছেন অতিরিক্ত ভাড়া-নৈরাজ্য বন্ধ করা, চালকের প্রশিক্ষণ, ঈদযাত্রায় মোটরসাইকেল নিষিদ্ধ করা, ঈদের পরে মনিটরিং কার্যক্রম বহাল রাখা, চালক-শ্রমিকদের বেতন-বোনাস ও কর্মঘণ্টা নিশ্চিত করা, জাতীয় সড়ক নিরাপত্তা কাউন্সিলকে কার্যকর প্রতিষ্ঠানে গড়ে তোলা। জনগণের দীর্ঘদিনের দাবি ছিল, দুর্ঘটনা রোধে একটি সময়োপযোগী সড়ক পরিবহন আইন করার। আইন হয়েছে। কিন্তু এর সঠিক প্রয়োগ হচ্ছে না। দুর্ঘটনার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের কঠোর শাস্তির নজির নেই। সড়ক পরিবহন সেক্টরে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা এবং দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণে এ সংক্রান্ত কমিটি ১১১টি সুপারিশ করেছিল, যেগুলো পূর্ণাঙ্গভাবে বাস্তবায়িত হয়নি।


সড়কে ৯ মাসে নিহত ৫৫৯৮ জন: চলতি বছরের প্রথম ৯ মাসে সড়ক দুর্ঘটনায় ৫ হাজার ৫৯৮ জন মারা গেছেন। তাদের মধ্যে ৩৪ শতাংশের বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায়। এ ছাড়া আহত হয়েছেন ৯ হাজার ৬০ জন। রোড সেফটি ফাউন্ডেশন এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানায়। সেখানে চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সড়ক দুর্ঘটনার বিস্তারিত তথ্য তুলে ধরা হয়। প্রতিবেদনে বলা হয়, ৯ মাসে দেশে ৫ হাজার ৪৮৫টি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে। এসব দুর্ঘটনায় নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে শিশু ৭২৯ ও নারী ৬৭৭ জন। আর পেশার দিক থেকে সবচেয়ে বেশি শিক্ষার্থীর মৃত্যু হয়েছে, সংখ্যাটি ৬৮৭। উল্লেখ্য, রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের হিসাবে ২০২৩ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় ৬ হাজার ৫২৪ জন নিহত হন।