তিন দফা বাড়িয়ে পহেলা ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত নির্ধারণ করা হয়েছিলো বাংলাদেশ থেকে হজের নিবন্ধনের সময়সীমা। কিন্তু শেষদিনে এসে দেখা যাচ্ছে- নিবন্ধন করেছেন প্রাপ্ত কোটার অর্ধেকের কিছু বেশি।
খবর : বিবিসি বাংলার।
বর্ধিত খরচের কারণে মুসলমানদের বহুল আকাঙ্ক্ষিত এই ‘ফরজ’ অনেকের সামর্থের বাইরে চলে যাচ্ছে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
অথচ সরকারি ও বেসরকারি দুই খাতেই গত বছরের তুলনায় প্যাকেজ মূল্য কমিয়ে নির্ধারণ করা হয়েছিল।
সরকারি ব্যবস্থাপনায় হজে যাওয়ার সর্বনিম্ন প্যাকেজ প্রায় পাঁচ লাখ ৭৯ হাজার টাকা ধার্য করা হয়। আর বেসরকারিভাবে সর্বনিম্ন প্যাকেজ প্রায় পাঁচ লাখ ৯০ হাজার টাকা।
বাংলাদেশ থেকে ২০২৩ সালে সরকারিভাবে হজ প্যাকেজের খরচ ধরা হয়েছিলো ৬ লাখ ৮৩ হাজার টাকা। বেসরকারি প্যাকেজে খরচের সর্বনিম্ন সীমা ৬ লাখ ৭২ হাজার টাকা স্থির করা হয়।
দেখা যাচ্ছে- দুই ব্যবস্থাপনায়ই প্রায় ৯০ হাজার টাকা করে কমানো হয়েছে ব্যয়।
তবুও শেষ দিনে ধর্ম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের হজ ব্যবস্থাপনা পোর্টালে মোট নিবন্ধিত হজ যাত্রীর সংখ্যা ৭৪ হাজারের কাছাকাছি দেখা যাচ্ছে। এর মধ্যে সরকারি মাধ্যমে চার হাজার ১৬৫ জন আর বেসরকারিভাবে ৭২ হাজার ৭১১ জন নিবন্ধন করেছেন।
তবে হজ অ্যাজেন্সিজ অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (হাব) সভাপতি শাহাদত হোসাইন তসলিম বিবিসি বাংলাকে জানান, এবারের যে লক্ষ্যমাত্রা সেখানে পৌঁছানো সম্ভব হবে না। যেকোনো কারণেই হোক এ বছর হজযাত্রীদের আগ্রহ কিছুটা কম।
এ বছর বাংলাদেশীদের জন্য কোটা রাখা হয় এক লাখ ২৭ হাজার ১৯৮টি। যার মধ্যে সরকারি ও বেসরকারি ব্যবস্থাপনার জন্য বরাদ্দ যথাক্রমে ১০ হাজার ১৯৮ এবং এক লাখ ১৭ হাজার।
হাব সভাপতি তসলিম নিবন্ধন পর্যাপ্ত না হওয়ার জন্য সার্ভার জটিলতাকেও দায়ী করেন। জানান, বুধবার সারাদিন সার্ভার ডাউন ছিল। এ কারণে অনেকেই নিবন্ধন সম্পন্ন করতে পারেননি।
অন্য বছরের সাথে খরচের হিসাবে ফারাক
ধর্ম মন্ত্রণালয় ২০২৪ সালের হজের খরচের যে হিসাব দিয়েছে, তাতে দেখা যাচ্ছে বাড়ি ভাড়া, বিমান টিকিট ও সার্ভিস চার্জ কমেছে আগের বছরের চেয়ে।
এ বছর বিমান ভাড়া এক লাখ ৯৪ হাজার ৮০০ টাকা, যা ২০২৩ সালে ছিল ১ লাখ ৯৭ হাজার ৭৯৭ টাকা।
এবার মক্কা ও মদিনায় বাড়ি ভাড়া এক লাখ ৬৯ হাজার ৪১০ টাকা। এই খাতে গত বছর হাজিদের ২ লাখ ৪ হাজার ৪৪৫ টাকা ব্যয় করতে হয়েছিলো।
২০২৩ সালে তাঁবু, ম্যাট্রেস, বিছানা, চাদর, বালিশ কম্বল, খাবার সরবরাহে মোয়াল্লেম সেবার সার্ভিস চার্জ এক লাখ ৬০ হাজার ৬৩০ টাকা। এবার এই সার্ভিস চার্জ ও অন্যান্য চার্জের মোট অংক এক লাখ ২৬ হাজার ৩৮৪ টাকা।
এর বাইরে পরিবহন ব্যয় বা ভিসা ফির মতো খরচগুলো প্রায় অপরিবর্তিতই রয়েছে।
কিভাবে প্যাকেজ মূল্য কমানো হলো এবার- এমন প্রশ্নে শাহাদত হোসাইন তসলিম বিবিসি বাংলাকে বলেন, হজের অনেকগুলো খরচ আছে যেগুলো নির্ধারিত। যেমন- বিমান ভাড়া কমানোর কোনো সুযোগ নেই। যেটা সরকারের নির্ধারিত থাকে সেটাই এখানে খরচ করতে হয়।
তাছাড়া সৌদি আরবে কিছু চার্জ আছে, যেগুলো সৌদি সরকার কর্তৃক নির্ধারিত।
‘শুধুমাত্র কম্প্রোমাইজ করা যায় মক্কা, মদিনার হোটেল ভাড়ায়। আর, মিনা-আরাফায় যে তাঁবু আছে সেগুলোর ক্যাটাগরি আছে। এ, বি, সি বা ডি ক্যাটাগরি নেয়া যায়।’
‘তো আমরা এই জায়গাগুলোতেই মূলত কম্প্রোমাইজ করেছি’, যোগ করেন তসলিম।
তার মতে, হাজিদের কাছে হোটেলের মানের চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ কোন হোটেল মক্কা, মদিনা, হারাম শরিফের কাছাকাছি। এসব ক্ষেত্রে দূরত্বটা একটু বাড়িয়ে খরচে ভারসাম্য আনা হয়েছে।
২০২২ সালে সরকারিভাবে হজে যেতে প্যাকেজ ধরা হয়েছিল পাঁচ লাখ ২৭ হাজার ৩৪০ টাকা। গত বছর কোরবানি ছাড়া প্যাকেজের ব্যয় ধরা হয়েছিল চার লাখ ৬২ হাজার ১৪৯ টাকা।
অর্থাৎ ওই বছরে হজের খরচ দেড় লাখ থেকে প্রায় দুই লাখ ২১ হাজার পর্যন্ত বেড়েছিল।
২০২০ সালে এই প্যাকেজের মূল্য ধার্য করা হয়েছিল জনপ্রতি তিন লাখ ৬১ হাজার ৮০০ টাকা।
তখন সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বিবিসি বাংলাকে জানিয়েছিলেন, অন্যান্য বছরের তুলনায় এই বছরে ডলারের দাম বৃদ্ধি, বিমান ভাড়া বেড়ে যাওয়া, সৌদি আরবে খরচ বেড়ে যাওয়ায় হজ প্যাকেজে বাড়িয়ে ধরতে হয়েছে।
ভারত-পাকিস্তানের তুলনায় খরচ কেমন
গত বছরের ১৬ নভেম্বর পাকিস্তানের হজ পলিসি ঘোষণা করেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ধর্ম বিষয়ক মন্ত্রী অনিক আহমেদ।
আগের বছরের তুলনায় এক লাখ রুপি কমিয়ে ১০ লাখ ৭৫ হাজার রুপি খরচ নির্ধারণ করা হয়েছে বলে জানান তিনি।
ডলারের বিনিময়মূল্যের হিসাবে বাংলাদেশী মুদ্রায় যা সোয়া চার লাখ টাকার সমপরিমাণ।
ভারতের সংখ্যালঘু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অধীন হজ কমিটি অব ইন্ডিয়া প্রতি বছর হজ পলিসি ঘোষণা করে থাকে।
সংস্থাটির ওয়েবসাইট থেকে জানা যাচ্ছে, এ বছর তারা সর্বনিম্ন যে হজ প্যাকেজ স্থির করেছে, রাজ্য বা স্থানভেদে সেটি তিন থেকে চার লাখ রুপি। বাংলাদেশী মুদ্রায় যা চার থেকে সাড়ে পাঁচ লাখের মধ্যে।
এসব দেশের তুলনায় বাংলাদেশ থেকে যাওয়া মুসলমানদের বেশি অর্থ খরচ করতে হয় বলে প্রচার করা হচ্ছে এমন অভিযোগ করে তসলিম বিবিসি বাংলাকে বলেন, ‘এটা সঠিক নয়।’
‘ভারতের এ বছরের প্যাকেজ আমিও দেখেছি। এটা আমাদের সমান, কোনো কোনো ক্ষেত্রে আমাদের চেয়ে বেশি। তাদের সরকারি প্যাকেজটা অপেক্ষাকৃত কম, কারণ সেখানে সরকার ভর্তুকি দেয়।’
হাব সভাপতির ব্যাখ্যা, ভারতের হজযাত্রীরা মক্কায় আজিজিয়ায় থাকেন, যেটি প্রায় আট কিলোমিটার দূরে।
‘বাংলাদেশের হাজিরা থাকেন একেবারে জিরো কিলোমিটার থেকে এক কিলোমিটারের মধ্যে। যাতে তারা যখন ইচ্ছা স্বাধীনভাবে আসা যাওয়া করতে পারেন।’
সৌদি আরবে অন্যান্য দেশের হজযাত্রীরাও অনেক দূরে থাকেন বলে তাদের গাড়ি দিয়ে আসা যাওয়া করতে হয়। ফলে একই বা কাছাকাছি খরচে বাংলাদেশ থেকে যাওয়া হাজিরা বেশি সুবিধা পান বলে মন্তব্য তার।
গত বছরের হিসেবে দেখা গেছে- খরচ প্রায় সব দেশেই তুলনামূলক বেড়েছে।
ইন্দোনেশিয়া থেকে একজন মুসলমানকে হজে যেতে হলে খরচ করতে হয়েছে তিন হাজার ৩০০ ডলার বা তিন লাখ ৪৭ হাজার ৩৪৭ টাকা, যা আগের বছরের তুলনায় প্রায় ৭০ শতাংশ বেশি। বাকিটা সরকারি ‘হজ ফান্ড ম্যানেজমেন্ট এজেন্সি’ তহবিল থেকে ভর্তুকি দেয়া হয়।
মালয়েশিয়ায় যেসব পরিবারের মাসিক আয় ৯৬ হাজার টাকার কম, সেইসব পরিবারের সদস্যদের জন্য সরকারিভাবে হজের খরচ ধরা হয়েছিলো দুই লাখ ১৮ হাজার ৭৫৪ টাকা। মাসিক আয় এর বেশি হলে দিতে হয় দুই লাখ ৫৮ হাজার ৬০০ টাকা। তবে, প্রাইভেট হজ প্যাকেজগুলো বাংলাদেশী টাকায় নয় লাখ টাকা থেকে শুরু হয়।
সিঙ্গাপুরে হজের সবচেয়ে কমমূল্যের প্যাকেজের জন্য দিতে হয়েছে ছয় লাখ ৬০ হাজার ৯২০ টাকা।
হজের কোটা যেভাবে নির্ধারিত হয়
মুসলিমদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় জমায়েত হচ্ছে হজ। কিন্তু কোনো দেশ তাদের ইচ্ছেমতো হজে লোক পাঠানোর সুযোগ নেই।
এর কারণ হচ্ছে, কোন দেশ থেকে কত মানুষ হজে যেতে পারবেন, তার কোটা নির্ধারণ করে দেয়া হয়।
বাংলাদেশ, পাকিস্তান এবং মালয়েশিয়াসহ বিভিন্ন মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ থেকে সৌদি আরবকে ক্রমাগত অনুরোধ করা হচ্ছিল হজের কোটা বাড়ানোর জন্য।
যদিও এবার করোনা মহামারীর পরের বছরগুলোতে বাংলাদেশকে কোটা পূরণ করতেই হিমশিম খেতে হয়েছে।
২০১৯ সালে ভারত থেকে হজের কোটা বাড়ানো হয়েছে। এটি এক লাখ ৭০ হাজার থেকে বাড়িয়ে দুই লাখ করা হয়েছে।
পাকিস্তান থেকে এর আগে দুই লাখ মুসলিম হজ করতে গেলেও এবার এক লাখ ৮০ হাজারের মতো সুযোগ পাচ্ছেন।
মালয়েশিয়া থেকে ২০১৯ সালে প্রায় ৩০ হাজার মুসলিম হজ পালন করতে গিয়েছিলেন।
হজের জন্য যেহেতু সৌদি আরবকে বিশাল আয়োজন করতে হয় হজের কোটা নির্দিষ্ট করাটাও তাই জরুরি হয়ে পড়ে।
মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশগুলোর সংগঠন অর্গানাইজেশন অব ইসলামিক কোঅপারেশন বা ওআইসির একটি সিদ্ধান্ত অনুযায়ী হজের এই কোটা নির্ধারণ করা হয়েছে।
ওআইসির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী প্রতি ১০ লাখ জনসংখ্যার মধ্যে এক হাজার জন হজে যেতে পারবেন।
হজ এজেন্সিস এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ সহ-সভাপতি এ.এস.এম ইব্রাহিম বিবিসি বাংলাকে বলেন, বাংলাদেশর জনসংখ্যা যেহেতু ১৬ কোটির বেশি, সেজন্য বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর এক লাখ ৬০ হাজার মানুষ হজ করতে যেতে পারার কথা।