আর্কাইভ | ঢাকা, সোমবার, ১২ মে ২০২৫, ২৯ বৈশাখ ১৪৩২, ১৩ জিলক্বদ ১৪৪৬ ০৭:৪০:৩৮ অপরাহ্ন
Photo
আন্তর্জাতিক ডেস্ক 
ঢাকা, প্রকাশিতঃ
১২ মে ২০২৫
১২:২১:৪৬ অপরাহ্ন

শক্তি দেখাতে যেয়ে দুর্বলতা প্রকাশ পেল ভারতের 


টানা কয়েকদিনের সংঘাতের পর গত ১০ মে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ঘোষণা দেন— ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে একটি “পূর্ণাঙ্গ এবং তাৎক্ষণিক” যুদ্ধবিরতি হয়েছে, আর সেটি সম্ভব হয়েছে তার প্রশাসনের মধ্যস্থতায়।


মার্কিন গণমাধ্যম জানিয়েছে, আরও বড় সংঘাতের আশঙ্কায় মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্স, পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও এবং হোয়াইট হাউসের চিফ অব স্টাফ স্যুজি ওয়াইলস জরুরি ভিত্তিতে এই সংঘাতের মধ্যস্থতা করেন।

এসময় জেডি ভ্যান্স ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে সম্ভাব্য বিপর্যয়ের বিষয়ে সতর্ক করে দেন এবং পাকিস্তানের সঙ্গে সরাসরি আলোচনার পরামর্শ দেন।


বিশ্বজুড়ে এই যুদ্ধবিরতির খবরে স্বস্তি দেখা দেয়। কারণ পারমাণবিক যুদ্ধের আশঙ্কা — যা এক গবেষণা অনুযায়ী এক সপ্তাহে প্রায় ১২.৫ কোটি মানুষের প্রাণ নিতে পারে — অঞ্চলজুড়ে দুশ্চিন্তা বাড়িয়ে দিয়েছিল এবং এটিই যুক্তরাষ্ট্রকে সক্রিয় কূটনৈতিক উদ্যোগ নিতে বাধ্য করে।

তবে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে দেওয়া এই যুদ্ধবিরতির ঘোষণাকে ভারতে অনেকে ভালোভাবে নেয়নি। ভারতের সাবেক সেনাপ্রধান ভেদ প্রকাশ মালিক সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম এক্সে (সাবেক টুইটার) লেখেন, “১০ মে’র এই যুদ্ধবিরতির পরে ভারতের ভবিষ্যৎ ইতিহাস হয়তো জানতে চাইবে, রাজনৈতিক বা কৌশলগতভাবে আসলে আমরা কী পেলাম।”


এছাড়া ভারতের সংসদ সদস্য আসাদুদ্দিন ওয়াইসি লেখেন, “আমি চাইতাম আমাদের প্রধানমন্ত্রী নিজেই যুদ্ধবিরতির ঘোষণা দিতেন, কোনও বিদেশি নেতা নয়। ১৯৭২ সালের শিমলা চুক্তির পর থেকেই আমরা তৃতীয় পক্ষের হস্তক্ষেপে বিরোধী ছিলাম। তাহলে এবার কেন গ্রহণ করলাম? আমি আশা করি কাশ্মির ইস্যু আন্তর্জাতিকভাবে তুলে ধরা হবে না, কারণ এটি আমাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়।”

ওয়াইসির বক্তব্যে মূলত ট্রাম্পের মন্তব্যের দিকেই ইঙ্গিত করা হয়েছে, যেখানে ট্রাম্প বলেন, “ভারত ও পাকিস্তানের সঙ্গে কাজ করতে চাই যাতে হাজার বছরের (সংঘাতের) পরও কাশ্মির নিয়ে কোনও সমাধানে পৌঁছানো যায়।”

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের যুদ্ধবিরতির ঘোষণা অনেক ভারতীয়র চোখে এসেছে মার্কিন চাপে মোদি সরকারের পিছু হটার নিদর্শন হিসেবে। আর ট্রাম্পের মধ্যস্থতার প্রস্তাব ভারতের বহুদিনের নীতির—“তৃতীয় পক্ষের হস্তক্ষেপ নয়”—তার অবক্ষয় বলেই ধরা হচ্ছে।


দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনীতিতে অনেক সময় ‘ধারণা’ বাস্তবতাকে ছাড়িয়ে যায়—যতক্ষণ না বাস্তবতা মুখের ওপর এসে পড়ে। ভারত অনেকদিন ধরে নিজেকে এই অঞ্চলের নেতৃত্বশীল শক্তি হিসেবে তুলে ধরেছে, অর্থনৈতিক অগ্রগতি ও পারমাণবিক শক্তির ওপর ভর করে।

কিন্তু ২২ এপ্রিল কাশ্মিরের পেহেলগামে বন্দুকধারীদের হামলার পর ভারতের প্রতিক্রিয়া দুর্বলতার দিকটাই বেশি স্পষ্ট করেছে। মূলত ভারতের উদ্দেশ্য ছিল শক্তি দেখানো, কিন্তু তার বদলে পাকিস্তানের অবস্থান আরও মজবুত হয়েছে, আর কূটনৈতিকভাবে মোদি সরকার পিছিয়ে পড়েছে।

গত ৭ মে ভারত ‘অপারেশন সিন্দুর’ নামে সামরিক অভিযান শুরু করে, যার লক্ষ্য ছিল পাকিস্তানের ভেতরে বিভিন্ন গোষ্ঠীর ঘাঁটি ধ্বংস করা। ফরাসি ‘রাফাল’ যুদ্ধবিমান ব্যবহার করে অভিযান মোদি সরকারের ‘দৃঢ় নেতা’ ভাবমূর্তি রক্ষার প্রচেষ্টা ছিল। কিন্তু এর সফলতা বিতর্কিত।

পাকিস্তান জানায়, এই হামলায় সাধারণ মানুষ, এমনকি শিশু পর্যন্ত নিহত হয়েছে; যদিও ভারত দাবি করে, কেবল সন্ত্রাসীদের লক্ষ্য করে আঘাত হানা হয়েছিল।

অন্যদিকে পাকিস্তান পাল্টা প্রতিক্রিয়ায় নিজস্ব যুদ্ধবিমান পাঠিয়ে ভারতের হামলা প্রতিহত করার দাবি করে। দেশটি বলেছে, তারা পাঁচটি ভারতীয় যুদ্ধবিমান ভূপাতিত করেছে, যার মধ্যে তিনটি ছিল রাফাল ফাইটার জেট।

বার্তাসংস্থা রয়টার্সকে দুজন মার্কিন কর্মকর্তা জানান, চীনের তৈরি একটি জে-১০ যুদ্ধবিমান অন্তত দুইটি ভারতীয় বিমান ভূপাতিত করেছে, যেখানে চীনের গোয়েন্দা, নজরদারি ও টার্গেটিং সহায়তা ছিল। তবে ভারত কোনও বিমান হারানোর কথা প্রকাশ্যে স্বীকার করেনি।


ভারতের সংবাদমাধ্যম শুরুতে দাবি করেছিল, করাচির বন্দরসহ পাকিস্তানের বড় বড় শহরে ধ্বংসাত্মক হামলা হয়েছে, কিন্তু পরে দেখা যায়, সেগুলো ছিল প্রচারণার অংশ—বাস্তবতা নয়।

এরপর গত ৯ মে ভারত দাবি করে, তারা ইসলামাবাদ সংলগ্ন একটি ঘাঁটিসহ পাকিস্তানের কয়েকটি জায়গায় ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে। পাকিস্তান পাল্টা জবাবে স্বল্প-পাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন ব্যবহার করে ভারতের উধামপুর, পাঠানকোট, আদমপুর ও ভুজ বিমানঘাঁটিতে হামলা করে।

ভারতীয় বিমানবাহিনীর কর্মকর্তা ভিওমিকা সিং জানান, পাকিস্তানের এসব হামলায় সামরিক ও বেসামরিক দুই ধরনের লক্ষ্যবস্তুতেই আঘাত হানা হয়।

পাকিস্তানের হামলায় রাফাল ভূপাতিত, নির্মাতা সংস্থা দাসোর শেয়ারে ধস

এই ঘটনাগুলো ভারতের আঞ্চলিক নেতৃত্বের ভাবমূর্তিকে আঘাত করেছে। ভারতের ‘রাফাল’ সক্ষমতা যতটা মূল্যায়ন করা হয়েছিল, বাস্তবে তা কার্যকর হয়নি। পাকিস্তানের চীনের সহায়তায় গঠিত উন্নত নজরদারি ও তথ্য ব্যবস্থার কাছে তা পিছিয়ে পড়েছে।

চীনের সামরিক সহায়তা পাকিস্তানের প্রতি গত কয়েক বছরে ব্যাপক বেড়েছে। ২০২০ সাল থেকে পাকিস্তানের ৮১ শতাংশ অস্ত্র চীন থেকেই এসেছে।

গত কয়েক বছর ধরেই কিছু ভারতীয় প্রতিরক্ষা বিশ্লেষক সতর্ক করে আসছিলেন— চীনের সহযোগিতায় পরিচালিত পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ভারত ভালোভাবে প্রস্তুত নয়—বিশেষত যখন যুক্তরাষ্ট্র বা রাশিয়ার কাছ থেকে ভারতের বাস্তব সহায়তা বেশ সীমিত।

আবার কেউ কেউ অভিযোগ করেন, ভারতের পররাষ্ট্রনীতির ভুলে চীন ও পাকিস্তানের মধ্যকার সম্পর্ক আরও গভীর হয়েছে। কিন্তু দিল্লিতে এসব সতর্কতা উপেক্ষিতই ছিল। তবে সাম্প্রতিক এই ঘটনা ভারতের কৌশলগত সীমাবদ্ধতা উন্মোচন করে দিয়েছে। এখন আর বিষয়টি শুধু ধারণার মধ্যে নেই, বরং বিশ্বব্যাপী নজরদারির আওতায় এসেছে।

দিল্লি এখন হয়তো এই ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় প্রতিরক্ষা বাজেট বাড়াতে এবং তাদের নিয়ন্ত্রণে থাকা কাশ্মিরে আরও সামরিকীকরণ ঘটাতে পারে। কিন্তু ভবিষ্যৎ গড়ার পথ নির্ভর করছে দিল্লি ও ইসলামাবাদের বিচক্ষণতার ওপর। উত্তেজনার পরিবর্তে সংযমই হতে হবে নীতিনির্ধারণের মূলভিত্তি। অন্যথায় রাজনৈতিক বিপর্যয়, অর্থনৈতিক মন্দা ও কোটি মানুষের দুর্ভোগ অনিবার্য হয়ে উঠবে।

বিশ্বের সবচেয়ে দরিদ্র মানুষের এক-চতুর্থাংশ এবং ৩৫ কোটির বেশি নিরক্ষর প্রাপ্তবয়স্ক যেখানে বাস করে, সেই ভারত ও পাকিস্তানের পক্ষে দীর্ঘমেয়াদী সংঘাত চালিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। চলমান উত্তেজনা ভারতের অগ্রগতিকে থামিয়ে দিতে পারে, আবার পাকিস্তানের দুর্বল অর্থনীতিকে সম্পূর্ণ ভেঙে ফেলতে পারে—যার প্রভাব হবে প্রতিটি ছোট সফলতার চেয়ে বহুগুণ বেশি ক্ষতিকর।

কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল জাজিরায় এই মতামত প্রবন্ধটি লিখেছেন ইউসুফ নজর। তিনি একজন বিশ্লেষক এবং লেখক। এছাড়া ইউসুফ নজর সিটিগ্রুপের উদীয়মান বাজার বিনিয়োগের সাবেক প্রধান এবং ‘দ্য গ্যাদারিং স্টর্ম’ বইয়ের লেখক।