বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের মহাসচিব কাদের গনি চৌধুরী বলেছেন, অন্ধকার ঘোচাতে চাই সাংস্কৃতিক জাগরণ। সমাজের অন্যায়-অপরাধ নির্মূল করতে হলে, বিশেষ করে তরুণদের সাংস্কৃতিক জাগরণ প্রয়োজন।
তরুণদের বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ার শঙ্কা নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে ভাবতে হচ্ছে। আমাদের তরুণদের এক আলোকিত ভবিষ্যতের দিকে ধাবিত করতে হলে তাদের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের প্রতি উৎসাহিত করতে হবে। তাহলে তারা মননে ও আচরণে আলোকিত মানুষ হতে পারবে।
শনিবার বিকেল ৩টায় জাতীয় প্রেস ক্লাবের জহুর হোসেন চৌধুরী মিলনায়তনে মুক্ত বাংলাদেশে ‘স্বাধীন শিল্প সংস্কৃতি চর্চা’ শীর্ষক আলোচনা এবং জুলাই আন্দোলনের ওপর ভিত্তি করে নির্মিত চলচ্চিত্র ‘দ্য রিমান্ড’-এর টিজার প্রদর্শনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব বলেন।
অ্যাডভোকেট কে এম জাবিরের সভাপতিত্বে আলোচনায় অংশ নেন ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি শহিদুল ইসলাম, এনটিভির পরিচালক নুরুদ্দীন আহমেদ, ব্যারিস্টার ওমর ফারুক, অ্যাডভোকেট শাহ আহমেদ বাদল, সাংবাদিক এরফানুল হক নাহিদ, কামরুল হাসান দর্পণ, সাদিক আল আরমান, নায়ক মারুফ আকিব ও আবির পারভেজ প্রমুখ।
কাদের গনি চৌধুরী বলেন, ‘সংস্কৃতি মানবসভ্যতার একটি অন্যতম অনুষঙ্গ।
জীবনের পরতে পরতে সংস্কৃতির উপাদান জড়িয়ে রয়েছে। বিশ্বায়ন, শিল্পায়ন ও ডিজিটাইজেশনের কারণে সংস্কৃতির উপাদানগুলো বিভিন্ন দেশের মধ্যে বিনিময় হয়। সংগত কারণে সংস্কৃতির সঙ্গে উপসংস্কৃতির একটি যোগসাজশ থাকে। উপসংস্কৃতির ও অপসংস্কৃতির প্রভাব যখন আধিক্য বিস্তার করে তখনই মূলত সাংস্কৃতিক সংকট তৈরি হয়, বিদেশনির্ভরতা চলে আসে অনেকের মধ্যে।
তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশে একটা সাংস্কৃতিক জাগরণের বড্ড প্রয়োজন। এ জাগরণের মধ্য দিয়ে সব ধরনের অনিয়ম, অন্যায়, নৈরাজ্য চিরতরে রুখে দেওয়া সম্ভব। এ জাগরণের মধ্য দিয়ে অনাবিষ্কৃত সভ্যতার নিদর্শনগুলো জাতীয় সম্পদে পরিচিতি পাবে এবং জাতীয় অর্থনীতিতে বিশেষ করে পর্যটন খাতে অপার সম্ভাবনার সৃষ্টি হবে।’
সাংবাদিকদের এ নেতা বলেন, ‘সারা দুনিয়া সাংস্কৃতিক জাগরণের ওপর বিশেষ গুরুত্ব প্রদান করেছে। তারা অনুধাবন করতে সক্ষম হয়েছেন অনিয়ম, অসংগতি, অপরাধ, নৈরাজ্য, সাম্প্রদায়িকতা থেকে জাতিকে সুরক্ষিত করার অন্যতম একটি গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন হতে পারে সাংস্কৃতিক জাগরণ।
একমাত্র সাংস্কৃতিক জাগরণই পারে সব পেশা-শ্রেণির মানুষকে একসূত্রে, এক কাঠামোয়, সুনির্দিষ্ট অঙ্গীকারে দাঁড় করাতে।’
সাংস্কৃতিক জাগরণের জন্য একটি আলোড়ন জরুরি উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘একটি শ্রেণি রয়েছে, যারা দেশীয় সংস্কৃতির বিভিন্ন অনুসঙ্গ বয়কট করে বিজাতীয় সংস্কৃতির ওপর নির্ভর করে এবং বিজাতীয় সংস্কৃতিতে বিশ্বাসী শ্রেণিটি সামগ্রিকভাবে বিজাতীয় সংস্কৃতি আমাদের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে চায়। এদের ব্যাপারে সচেতন থাকতে হবে।’
কাদের গনি চৌধুরী উল্লেখ করেন, মধ্যযুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি আবদুল হাকিম বলেছিলেন, “দেশী ভাষা বিদ্যা যার মনে ন জুরায়, নিজ দেশ ত্যাগী কেন বিদেশ ন যায়’। তিনি যথার্থই বলেছিলেন এবং বর্তমান সময়েও তার ভাষ্য প্রাসঙ্গিক। যারা এ দেশে থেকে, এ দেশের আলো-বাতাসে বড় হচ্ছে কিন্তু দেশি সংস্কৃতির ওপর আস্থা নেই, উপরন্তু তারা বিদেশি সংস্কৃতির ওপর নির্ভর করে নিজেদের আলাদা পরিচয় প্রদানে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে তাদের বাংলাদেশে থাকার কোনো যৌক্তিকতা নেই।
তিনি বলেন, ‘মাইকেল মধুসূদন দত্ত বিলেতে ইংরেজি ভাষায় তার কবিগুণ প্রকাশ করতে সেখানে থিতু হয়েছিলেন। পরে বিদেশি ভাষায় ব্যর্থ হয়ে দেশে ফিরে দেশি ভাষায় কাব্যচর্চায় মনোনিবেশ করেন এবং সফল হন। তিনি তার কবিতায় বাংলা ভাষাকে অবজ্ঞা করে বিদেশি ভাষায় খ্যাতি অর্জনের ভুল সিদ্ধান্তের বিষয়ে তার পাঠকসমাজকে অবহিত করেন। এ ধরনের বহু ঘটনা পৃথিবীর ইতিহাসে রয়েছে। নিজস্ব সংস্কৃতি, ভাষা, কৃষ্টি অবজ্ঞা করে অন্য সংস্কৃতিতে থিতু হয়ে প্রতিষ্ঠা পাওয়া প্রায় অসম্ভব। সে কারণেই সাংস্কৃতিক জাগরণ অত্যন্ত প্রয়োজন যে জাগরণের মাধ্যমে দেশি গান, নৃত্য, কবিতা, নাটক, পুঁথি, দেশি ভাষায় নির্মিত চলচ্চিত্র ইত্যাদিকে ভালোবেসে স্বপ্নের বাংলাদেশ বিনির্মাণের অগ্রযাত্রায় তরুণ প্রজন্মের শামিল হওয়া জরুরি।’
তিনি বলেন, ‘সংস্কৃতির উপাদান যত বেশি সমৃদ্ধ, সভ্যতার বিকাশেও ওই জাতির উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আনয়ন সম্ভব। সংস্কৃতি ও সভ্যতার পরিচর্যা মূলত একটি অন্যটিকে প্রভাবিত করতে পারে।’
সাংবাদিকদের এ নেতা বলেন, পূর্বপুরুষের হাত ধরে আবহমানকাল ধরে ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতা বজায় রেখে যে আচারাদিগুলো বাঙালির জীবনে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে তা বাঙালির সংস্কৃতি। বাংলার গান, কবিতা, চলচ্চিত্র, সংলাপ, নাটক, উৎসব, পার্বণ ইত্যাদি উৎস মানবজীবনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িয়ে আছে। কাজেই এ বিষয়গুলোই বাঙালির জীবনের সংস্কৃতি। সংস্কৃতির ওপর ভর করেই সামাজিক কাঠামোগুলো স্থিতিশীল হয়, গতিশীলতা পায় সামাজিক কর্মকাণ্ডগুলো। নিজস্ব সংস্কৃতিতে যে জাতি যত বেশি শক্তিশালী এবং নিজস্ব সংস্কৃতির ওপর অব্যাহত চর্চায় অনুশীলন করে সে জাতি কৃষ্টি-কালচারের দিক দিয়ে সমৃদ্ধির পাশাপাশি অর্থনৈতিকভাবেও শক্তিশালী ও সমৃদ্ধ।
তিনি আরো বলেন, ‘সংস্কৃতি একটি জাতির সুস্থির তথা সমৃদ্ধ অবস্থা তুলে ধরতে সহায়তা করে। আঞ্চলিক ভাষাগুলো বিশেষ করে আদিবাসী ভাষাগুলো টিকিয়ে রাখতে হবে, সেজন্য পদক্ষেপ গ্রহণ জরুরি। ভাওয়াইয়া, ভাটিয়ালি, জারি, সারি, প্রবাদবাক্য প্রভৃতি বিষয়ের ব্যবহার ও অনুশীলন পর্যায়ক্রমে কমে আসছে। এ জায়গাগুলোয় উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে যেমন জাতীয় পর্যায়ে লোকসংগীত, পুরোনো দিনের গান এবং উল্লিখিত গানসমূহ উপজীব্য করে প্রতিযোগিতা আয়োজন করতে হবে। কেননা সংস্কৃতির চর্চা যত বেশি হবে সভ্যতার বিকাশমান ধারা তত বেশি পরিমাণে আলোড়িত হবে এবং আবিষ্কৃত হবে।’
কাদের গনি চৌধুরী বলেন, ‘সংস্কৃতিকর্মীদের মহড়ার জায়গা নেই, প্রদর্শনের মঞ্চ নেই। পড়াশোনার পাঠাগার নেই, আলোচনার জন্য নেই ফ্রি সেমিনার হল। অন্যদিকে জায়গা, ভবন ও মঞ্চ বেশুমার পতিত হয়ে আছে। অব্যবহৃত জেলা ও উপজেলা সদরের টাউন হলগুলো, পৌর মার্কেট, উপজেলার মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্স ও ইউনিয়ন পরিষদ ভবনগুলো। নদী, পুকুর, পার্ক ও হাট উৎসবহীন।’
তিনি এ-ও বলেন, ‘শিল্পীরা না খেয়ে মরেন, যাপন করেন অসম্মানিত জীবন। বই পড়ার সুযোগ নেই। শিল্পীদের পরস্পরের সঙ্গে যোগাযোগ নেই। চিত্রশিল্পীদের ছবি প্রদর্শনের গ্যালারি নেই, সিনেমা দেখার সুযোগ নেই। ব্যক্তিমালিকানার হলগুলো বন্ধ হওয়ায় সিনেমা দেখাও প্রায় বন্ধ।’
তিনি বলেন, ‘টাউন হলগুলোর ডিজাইন দেখলেই বোঝা যায়, হাসিনা সরকার টাউন হল চিনত না, কমিউনিটি সেন্টার চেনে। প্রত্যেক স্বৈরাচারের মতো তারাও চায়নি সংস্কৃতিচর্চার বিকাশ। এগুলোর টাইলস উঠিয়ে কিছু ইট ধাপে ধাপে বসালেই সত্যিকারের টাউন হলে পরিণত হবে। টাইলস বসানোর সংস্কৃতি থেকে বের হলে লাখখানেক টাকাতেই এটি সম্ভব। সে টাকাও স্থানীয় ধনাঢ্য ব্যক্তিরা দেবেন, যদি কোথাও দাতা হিসেবে তাঁর নাম থাকে।’
ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি শহিদুল ইসলাম জুলাই বিপ্লবের শহীদদের নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মান করায় নির্মাতাদের ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, বিগত ফ্যাসিবাদী সরকারের আমলে যত গুম, খুন , ক্রসফায়ার, আয়নাঘর, পিলখানা হত্যাকান্ড, শাপলাচত্বরে হেফাজতের আলেমদের হত্যাকান্ডসহ সব গোপন বন্দীশালা নিয়ে আলাদা চলচ্চিত্র নির্মান করতে হবে।