এসব পুলিশ সদস্য যাতে দেশ থেকে পালাতে না পারে সে ব্যাপারে ইমিগ্রেশনকে সতর্ক করে রাখা হয়েছে। তারা অনলাইন-অফলাইনে কাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছে এসব মনিটরিং করা হচ্ছে।
জুলাই বিপ্লবের ছয় মাসের মাথায় ফ্যাসিস্ট সমর্থিত কতিপয় পুলিশ কর্মকর্তা গোপন তৎপরতায় লিপ্ত রয়েছে বলে গোয়েন্দা কর্মকতাদের কাছে তথ্য রয়েছে। এমন তথ্য পেয়ে গোয়েন্দারা কয়েক ডজন পুলিশ সদস্যকে নজরদারিতে রেখেছেন। তাদের কর্মকাণ্ড মনিটরিং করা হচ্ছে। এসব পুলিশ সদস্য যাতে দেশ থেকে পালাতে না পারে সে ব্যাপারে ইমিগ্রেশনকে সতর্ক করে রাখা হয়েছে। তারা অনলাইন-অফলাইনে কাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছে এসব মনিটরিং করা হচ্ছে।
সম্প্রতি পালাতক সাবেক আইজিপি বেনজির আহমেদ ভার্চুয়ালি মিটিং করায় সড়যন্ত্রের বিষয়টি সরকারের নজরে আসে। এরই মধ্যে একজন ডিআইজিসহ চার পুলিশ কর্মকর্তাকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তাদেরকে রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। আরও কয়েকজন পুলিশ কর্মকর্তাকে শিগগিরই গ্রেফতার করা হতে পারে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।
১৫ ববছরের বেশি সময় ধরে ক্ষমতায় থাকা স্বৈরশাক শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে গেলেও সেখান থেকে দেশে থাকা আওয়ামী লীগের কতিপয় নেতা এবং কয়েকজন পুলিশ কর্মকর্তার সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখছেন বলে জানা গেছে। বিদেশে পালিয়ে যাওয়া কয়েকজন পুলিশ কর্মকর্তার সঙ্গেও তিনি অনলাইনে যোগাযোগ করছেন। ওইসব পুলিশ সদস্যকে সংগঠিত করে দেশে একটি অরাজকতা সৃষ্টি করতে ইন্ধন দিচ্ছে। এরই মধ্যে গত পাঁচ ফেব্রুয়ারি শেখ হাসিনা ভারত থেকে নিষিদ্ধ ঘোষিত ছাত্রলীগের সঙ্গে অনলাইনে বক্তব্য দেয়ার ঘোষণা দেয়। আর এতে বিক্ষুব্ধ হয় দেশের বিপ্লবী ছাত্র-জনতা। ক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতা রাজধানীর ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে শেখ মুজিবুর রহমানের বাড়িসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় আওয়ামী লীগ নেতাদের বাড়িঘরে হামলা-ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়। বিভিন্ন স্থানে ভেঙ্গে ফেলা হয় শেখ মুজিবুর রহমানের ম্যুরাল। এরই মধ্যে সাবেক পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজি) বেনজীর আহমেদের একটি কথোপকথন সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হয়। ভার্চুয়াল বৈঠকে পলাতক আওয়ামী লীগ নেতাদের উদ্দেশে তিনি বিভিন্ন মন্তব্য করেন।
ওই আলোচনায় বেনজীর আহমেদ বলেন, ‘আপনারা যখন (আওয়ামী লীগ) সংগঠিত হবেন, তখন পুলিশের উপস্থিতি আপনাদের সামনে থাকবে, এতে কোনো সন্দেহ নেই। বিএনপি-এরশাদের আমলে অনেক এমপি পুলিশের মধ্যে তাদের লোক ঢুকিয়েছিল। এসব লোক এখনো পুলিশে রয়েছে, যারা নিজেরা পার্টির সঙ্গে যুক্ত এবং রাজনৈতিক কাজে সক্রিয়। এ ধরনের পুলিশ সদস্যদের এখনো অনেকে তাদের কাজে সক্রিয় এবং রাজনৈতিক অবস্থান নিতে প্রস্তুত। এছাড়াও তিনি অনলাইনে গোপনে কতিপয় পুলিশ সদস্যের সঙ্গে বৈঠকে করেছেন বলে গোয়েন্দাদের কাছে তথ্য রয়েছে। তাদের মনোবল সৃষ্টি করার চেষ্টা চালাতে চাচ্ছে বিদেশে পলাতক বেনজির আহমেদ।
বেনজীর আহমেদ ক্ষমতাচ্যুত সরকারের অনুসারীদের সঙ্গে ভার্চুয়াল বৈঠক এবং পুলিশ বাহিনী সম্পর্কে ষড়যন্ত্রমূলক বক্তব্যকে রাষ্ট্রবিরোধী উল্লেখ করেছে বাংলাদেশ পুলিশ অ্যাসোসিয়েশন। বেনজীর আহমেদের এ ধরনের কর্মকা-ের তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদও জানিয়ে একটি বিবৃতি দিয়েছে সংস্থাটি। এতে আরও বলা হয়, সম্প্রতি গণহত্যা, দুর্নীতি, মানি লন্ডারিংসহ একাধিক মামলায় জড়িত পলাতক সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদ বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনী সম্পর্কে ফ্যাসিস্ট সরকারের অনুসারীদের সঙ্গে ভার্চুয়াল কনফারেন্সে একটি ষড়যন্ত্রমূলক সভায় অংশগ্রহণ করেন বলে জানা যায়। এ বক্তব্যটি বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনী ও এর সদস্যদের পেশাদারিত্বকে চরমভাবে ক্ষুন্ন করেছে বলে মনে করে বাংলাদেশ পুলিশ অ্যাসোসিয়েশন। এ ধরনের সভায় অংশগ্রহণ এবং বক্তব্য প্রদান দেশের বিরুদ্ধে গভীর ষড়যন্ত্র এবং রাষ্ট্রদ্রোহিতার শামিল। ব্যক্তির দায়ভার কখনো কোনো বাহিনী বহন করে না। প্রতিবাদলিপিতে আরও বলা হয়, ২০১৩ সালে হেফাজতের বিরুদ্ধে ঢাকার মতিঝিল শাপলা চত্বরে সংঘটিত গণহত্যা, হাজার কোটি টাকার দুর্নীতির ঘটনায় সম্পৃক্ততা ও দুদকের একাধিক মামলায় অভিযুক্ত একজন ব্যক্তির বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনী, সরকার ও রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে এ ধরনের কর্মকা-ে বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনীর সব পুলিশ সদস্য মর্মাহত এবং ক্ষুব্ধ।
সিম্প্রতি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে বিতর্কিত ভূমিকা ও বিগত সময়ে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে অপরাধ কার্যক্রমে জড়িত পুলিশসহ সরকারি কর্মকর্তাদের ধরা হবে বলে জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী। তিনি বলেছেন, অপরাধী যারাই হোক, আমরা সবাইকে আইনের আওতায় নিয়ে আসবো।
জানা গেছে, বর্তমানে বাংলাদেশে মোট পুলিশের সংখ্যা ২ লক্ষ ১২ হাজার। বিগত ১৭ বছরে ১লক্ষ ৬৯ হাজার পুলিশ নিয়োগ দেয়া হয়েছে এবং এরা সবাই আওয়ামী লীগের পরিবারের সদস্য দেখে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। জুলাই বিপ্লবে ছাত্র-জনতার ওপর পাখির মতো গুলি চালায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। পুলিশ, র্যাব, বিজিবি, বিডিআর, এপিবিএনসহ কোনো সংস্থা পিছিয়ে ছিল না। জুলাই আগস্টে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গুলিতে প্রায় দুই হাজার ছাত্র-জনতা নিহত হয়। আহত হয় ২৫ হাজারের মতো। পাঁচ আগস্টের আগে ও পরে কতিপয় পুলিশ কর্মকর্তা পালিয়ে বিদেশে চলে যায়। সাবেক দুই আইজিপিসহ কয়েকজন পুলিশ কর্মকর্তা গ্রেফতার হয়েছেন। এছাড়াও ভেঙে পড়া আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে পুলিশে ব্যাপক রদবদল করা হয়। ঢাকার অধিকাংশ পুলিশকে বদলি করা হয়। এভাবে অন্যান্য মেট্টোপলিটন ও রেঞ্জের পুলিশ সদস্যকে রদবদল করা হয়। মানবতা বিরোধী অপরাধে জড়িত থাকায় কয়েকজন পুলিশ সদস্য অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বিচার চলছে। কিন্তু ছয়মাস পার হলেও এখনো পুলিশের তৎপরতা আগের মতো হয়নি এমন অভিযোগ রয়েছে।
সূত্র জানায়, গণভ্যুত্থানের পর গত ছয় মাসে রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে প্রায় দুই হাজার ৬০০ মামলা হয়েছে। এসব মামলায় আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মী, পতিত সরকারের সহযোগী হিসাবে চিহ্নিত আমলা, ব্যবসায়ী ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সাবেক-বর্তমান সদস্যদের আসামী করা হয়েছে। এদের মধ্যে গ্রেফতার করা হয়েছে ৩২ পুলিশসহ ১১৫ হাই প্রোফাইল ব্যক্তিকে। সূত্র জানায়, গ্রেফতারের জন্য প্রায় দুই শত পুলিশ সদস্য ও কয়েকশ আওয়ামী লীগের হাই প্রোফাইল নেতাকে খুঁজছে পুলিশ। ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর থেকে এ পর্যন্ত যেসব পুলিশ সদস্য গ্রেফতার হয়েছেন তাদের মধ্যে আছেন-সাবেক আইজিপি একেএম শহিদুল হক, সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন, সাবেক অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার আব্দুল্লাহ হিল কাফি, ডিএমপির সাবেক কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া, ডিএমপি ডিবির সাবেক উপকমিশনার মশিউর রহমান, যাত্রাবাড়ী থানার সাবেক ওসি আবুল হাসান, গুলশানের সাবেক ওসি মাজহারুল ইসলাম, গোয়েন্দা গুলশান বিভাগের সহকারী কমিশনার ইফতেখার মাহমুদ, ট্রাফিক ওয়ারী বিভাগের সহকারী কমিশনার (এসি) তানজিল আহমেদ, এসপি শাহেন শাহ, অতিরিক্ত এসপি রফিকুল ইসলাম, কনস্টেবল সুজন হোসেন, এসআই শাহাদাত আলী, কনস্টেবল শোয়াইবুর রহমান, নায়েক সজিব সরকার, কনস্টেবল বায়েজিদ বোস্তামী, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার জুয়েল রানা, অতিরিক্ত ডিআইজি মহিউদ্দিন ফারুকী, মিরপুর বিভাগের সাবেক ডিসি জসিম উদ্দিন, সাবেক অতিরিক্ত পুলিশ সুপার অলেপ উদ্দিন প্রমুখ। এছাড়া শুক্রবার রাতে গাজীপুর মহানগর পুলিশের (জিএমপি) সাবেক কমিশনার মোল্যা নজরুল ইসলামসহ চার পুলিশ কর্মকর্তাকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে পুলিশের বিভিন্ন ইউনিটের সদস্যরা তাদের আটক করেন।
এদিকে গ্রেফতার তালিকায় থাকা পুলিশ কর্মকর্তার মধ্যে আছেন-সাবেক অতিরিক্তি আইজিপি (সাবেক এসবি প্রধান) মনিরুল ইসলাম, সাবেক র্যাব ডিজি হারুন অর রশীদ, ডিএমপির সাবেক কমিশনার হাবিবুর রহমান, সাবেক ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার একেএম হাফিজ আক্তার, ডিএমপি ডিবির সাবেক অতিরিক্ত কমিশনার মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ, সাবেক যুগ্ম-কমিশনার বিপ্লব কুমার সরকার, এসএম মেহেদী হাসান, ওয়ারী বিভাগের সাবেক ডিসি ইকবাল হোসাইন, ডিএমপির সাবেক কমিশনার খন্দকার গোলাম ফারুক, সিআইডির সাবেক প্রধান মোহাম্মদ আলী মিয়া, সাবেক অতিরিক্ত আইজি লুৎফর কবির, জামিল আহম্মেদ, র্যাবের সাবেক ডিজি এম খুরশিদ হোসেন, ডিএমপির সাবেক অতিরিক্ত কমিশনার ড. খন্দকার মহিদ উদ্দিন, ঢাকা রেঞ্জের সাবেক ডিআইজি সৈয়দ নুরুল ইসলাম, সিটিটিসির সাবেক অতিরিক্ত কমিশনার আসাদুজ্জামান, সিটিটিসির সাবেক যুগ্ম-কমিশনার কামরুজ্জামান, সাবেক ডিআইজি রিপন সরদার, সাবেক অতিরিক্ত ডিআইজি প্রলয় কুমার জেয়াদ্দার, সাবেক যুগ্ম-কমিশনার মোহাম্মদ আনিসুর রহমান, ঢাকা রেঞ্জের সাবেক অতিরিক্ত ডিআইজি মারুফ হোসেন সরদার, ডিএমপি ডিবির সাবেক যুগ্ম-কমিশনার সঞ্জিত কুমার রায়, ডিএমপি ডিবি রমনা বিভাগের সাবেক ডিসি মোহাম্মদ আশরাফুল ইসলাম, সাবেক ডিসি (হেডকোয়ার্টার্স) তানভির সালেহীন ইমন, ডিবির সাবেক ডিসি রাজিব আল মাসুদ, উপকমিশনার মাহফুজুল আল রাসেল, জাহিদুল হক তালুকদার, হায়াতুল ইসলাম, আশরাফুল আজিম, এইচএম আজিমুল হক, হাফিজু আল ফারুক, মাহাবুব-উজ-জামান, জাফর হোসেন, অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (এডিসি) নুরুল আমিন, গোবিন্দ চন্দ্র, শাহেন শাহ, হাফিজ আাল আসাদ, মুহিত কবির সেরনিয়াবাত, শহিদুল ইসলাম, হাসান আরাফাত, নাজমুল ইসলাম, সাব্বির রহমান, আফজাল হোসেন টুটুল, ফজলে এলাহী, রওশানুল হক সৈকত, শাকিল মোহাম্মদ শামীম, সহকারী কমিশনার (এসি) রেফাতুল ইসলাম রিফাত, শাহীনুর রহমান প্রমুখ।