আবুল কাশেমের বাঁশি বাজিয়েছেন সবাই 
আর্কাইভ | ঢাকা, সোমবার, ১০ মার্চ ২০২৫, ২৬ ফাল্গুন ১৪৩১, ৯ রমজান ১৪৪৬ ০৭:০৭:৩৫ অপরাহ্ন
Photo
এখন বাংলা ডেস্ক
ঢাকা, প্রকাশিতঃ
০৮ ফেব্রুয়ারী ২০২৫
০১:০২:৪০ পূর্বাহ্ন

আবুল কাশেমের বাঁশি বাজিয়েছেন সবাই 


বাঙালির সবচেয়ে আপন বাদ্যের নাম বাঁশি। বাঁশির মোহনীয় সুরে প্রাণ জুড়ায় না এমন মানুষ পাওয়া কঠিন। নজরুলের 'মধুর বাঁশরী' থেকে রাখালের ডাকাতিয়া বাঁশি—উচ্চ সংস্কৃতি থেকে লোক সংস্কৃতি, সর্বত্রই বাঁশির সুরের উপস্থিতি।

কুমিল্লার হোমনা উপজেলার মেঘনা নদীর তীরে শ্রীমদ্দি নামের একটি গ্রাম রয়েছে। এ গ্রামের মানুষের প্রধান পেশা বাঁশি তৈরি। প্রায় চার প্রজন্ম ধরে তারা এই কাজের সঙ্গে যুক্ত। শ্রীমদ্দির কাঁচাপাকা পথ ধরে হাঁটতে গেলে ঘরের ভেতর থেকে ভেসে আসে বাঁশির মধুর সুর।

এই গ্রামের কারিগররা প্রায় ১৬ থেকে ২০ ধরনের বাঁশি তৈরি করতে পারেন। ক্লাসিকাল বাঁশি, আড় বাঁশি, মোহন বাঁশি, বীণ বাঁশি, ক্যালেনর বাঁশি, পাখি বাঁশি, নাগিন বাঁশি, বেলুন বাঁশি, মুখ বাঁশি, ফেন্সি বাঁশি, খানদানি বাঁশি—এর প্রতিটি নিজস্ব বৈশিষ্ট্যে ভরা।

দেশের প্রায় সব পেশাদার বংশীবাদক শ্রীমদ্দির তৈরি বাঁশি ব্যবহার করেন। দেশজুড়ে বাদ্যযন্ত্র বিক্রেতারা এখান থেকে বাঁশি সংগ্রহ করেন। বিশেষ করে পহেলা বৈশাখের সময় বাঁশির চাহিদা থাকে তুঙ্গে।

শুধু দেশেই নয়, বিদেশেও শ্রীমদ্দির বাঁশি পৌঁছে যায়। ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, জার্মানি, আমেরিকা, ইতালি, কানাডাসহ প্রতিবেশী দেশ ভারত, পাকিস্তান, নেপাল ও ভুটানেও নিয়মিত রপ্তানি করা হয় এসব বাঁশি।

শুরুর গল্প
প্রায় ২০০ বছর আগে শ্রীমদ্দি গ্রামের দুই বাসিন্দা কোকিল দাস বৈরাগী ও দীনবন্ধু তৎকালীন ভারতবর্ষের বিভিন্ন অঞ্চলে ঘুরে বাঁশি তৈরি শেখেন। দুজনেই ছিলেন দক্ষ বংশীবাদক। গ্রামে ফিরে তারা বাঁশ দিয়ে বাঁশি বানানো শুরু করেন।

নিজেদের তৈরি বাঁশি বাজানো এবং ফেরি করে বিক্রি করাই ছিল তাদের জীবিকা। ধীরে ধীরে তাদের হাত ধরে বাঁশি তৈরির এই শিল্প ছড়িয়ে পড়ে গ্রামে।


আড় বাঁশিতে সুর তুলছেন আবুল কাশেম।
দেশভাগের সময় কোকিল বৈরাগী ও দীনবন্ধু পরিবারসহ ভারতে চলে গেলেও শ্রীমদ্দিতে রেখে যান বাঁশি তৈরির এই অমূল্য শিল্প। সময়ের সঙ্গে নানা চ্যালেঞ্জের মধ্যেও এই শিল্প এখনো টিকে আছে।

বর্তমানে গ্রামের ৩০-৪০টি পরিবার বাঁশি তৈরির কাজে নিয়োজিত। প্রবীণ কারিগর আবুল কাশেম বলেন, "স্বাধীনতার আগে বাঁশির চাহিদা অনেক বেশি ছিল। বাপ-দাদাদের দেখতাম দুই মাস খেটে বাকি সময়টা আরামে কাটাত। এখন সারা বছরই কষ্ট করতে হয়।"

বাঁশি তৈরির প্রক্রিয়া
বাঁশি তৈরির প্রধান উপকরণ মুলি বাঁশ, যা চট্টগ্রাম, মিরসরাই, সীতাকুণ্ড এবং রাঙামাটি থেকে সংগ্রহ করা হয়। বাঁশগুলো কেনার পর ভালো মানের বাঁশ আলাদা করে পরিষ্কার করা হয়। এরপর চাহিদামতো আকারে কাটা হয়। বাঁশ কাটার পর ধুয়ে রোদে শুকানো হয় কয়েকদিন।


আন্দামান ও নিকোবার দ্বীপপুঞ্জে বাঁশি পাঠানোর ঠিকানা।
একটি ছোট বাঁশি তৈরিতেও ১৩-১৪টি ধাপ অতিক্রম করতে হয়। পুরো প্রক্রিয়ায় প্রায় ২০-২২ জন লোকের পরিশ্রম লাগে। কেউ বাঁশ পরিষ্কার করেন, কেউ কাটেন, কেউ শুকানোর দায়িত্বে থাকেন। সবমিলিয়ে বাঁশি বানানো কোনো চাট্টিখানি কাজ নয়!

আবুল কাশেমের বাঁশি বাজিয়েছেন সবাই
আড় বাঁশি তৈরির পর এটি পেঁচানো হয় নানা রঙের বাহারি সুতো দিয়ে। লাল, হলুদ, সবুজ আর নীল রঙই বেশি ব্যবহার করা হয়। কেন এই সুতার ব্যবহার? আবুল কাশেম বলেন, "প্রথম কথা হলো দেখতে সুন্দর লাগে এভাবে সুতা পেঁচাইলে। তাছাড়াও সুতা দিয়ে বাঁধন দিলে বাঁশিটার গড়ন মজবুত হয়। হাত থেকে পড়লে ফাটে না। টিকে বেশি দিন। অনেকে কাস্টম অর্ডারে বলে দেয় কোন রঙের সুতা পেঁচাইতে হবে। আবার অনেকে স্কেল অনুযায়ী সুতা পেঁচানো বাঁশির অর্ডার দেয়।"

কোনো বিখ্যাত শিল্পী কি আপনার থেকে বাঁশি বানিয়ে নিয়েছে কখনো?" এ প্রশ্নের জবাবে আবুল কাশেম মুখ টিপে গর্বের হাসি হেসে বললেন, "আপনি গত ৩০-৩৫ বছরে বাংলাদেশের সব সেরা বাঁশির শিল্পীর নাম বলতে থাকেন। আমার থেকে বাঁশি নেয় নাই এমন কারও নাম যদি শুনি, আমি আপনাকে থামাব।"

আবুল কাশেম আরও বলেন, "ওস্তাদ আজিজুল ইসলাম, ওস্তাদ শামসুল হক, ওস্তাদ ধীর আলী থেকে শুরু করে জালাল- সবার জন্যই আমি বাঁশি বানিয়েছি। বারী সিদ্দিকী ভাই আমার বাড়িতে এসে বাঁশি অর্ডার করে নিয়ে যাইতেন। বাংলাদেশের এমন কোনো পেশাদার বংশীবাদক নাই, যার জন্য আমি বাঁশি বানাই নাই। ওপরওয়ালা হাত দিছেন, আমি বানাইতেছি শুধু। যতদিন বেঁচে আছি, বানায়ে যাব।