আর্কাইভ | ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ৩০ জানুয়ারী ২০২৫, ১৭ মাঘ ১৪৩১, ২৯ রজব ১৪৪৬ ০২:৪২:৩৬ অপরাহ্ন
ঢাকা, প্রকাশিতঃ
২৯ জানুয়ারী ২০২৫
০৯:৪৯:১৩ পূর্বাহ্ন

সরকারকে সবাই দুর্বল ভাবছে: মাহমুদুর রহমান


জুলাই বিপ্লবের পর যে প্রচণ্ড জনসমর্থন নিয়ে ইউনূস সরকার ক্ষমতায় এসেছিল দৃশ্যত তাতে টান ধরেছে। জনপ্রিয়তা কমে যাওয়ার পেছনে সরকারের ব্যর্থতার পাশাপাশি সুগভীর দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্র কাজ করছে। আগে সরকারের ব্যর্থতার আলাপ করা যাক।

ফ্যাসিস্ট হাসিনার পতন ও পলায়নের পর মেগা প্রজেক্টের মেগা দুর্নীতি কমে এলেও আমলাতন্ত্র কর্তৃক জনগণকে হয়রানি এবং তাদের ঘুষগ্রহণ এখনো নিয়ন্ত্রণে আসার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। চালের দাম বেড়েই চলেছে, রাস্তায় যানজট লেগেই আছে, বছরের শুরুতে স্কুলে বই দেওয়া সম্ভব হয়নি, রাজধানীতে ছিনতাই বাড়ছে, পুলিশের নিজেদের অপরাধে হারিয়ে যাওয়া মরাল ফিরে আসেনি, বিভিন্ন যৌক্তিক-অযৌক্তিক দাবিতে রাস্তা অবরোধ প্রায় প্রতিদিন ঘটছে—ইত্যাকার বিষয় সরকারের ওপর জনগণের আস্থা বাড়াচ্ছে না।

আমলাতন্ত্রকে যে পাঁচ মাসের মধ্যেও নিয়ন্ত্রণে আনা গেল না, তার প্রধান কারণ হলো ইউনূস সরকার ২০২৪-এর অবিস্মরণীয় বর্ষা বিপ্লবকে পুরোপুরি ধারণ করে এগোতে পারেনি। তারা সামরিক ও বেসামরিক কোনো আমলাতন্ত্রেই দ্রুততার সঙ্গে অতি প্রয়োজনীয় শুদ্ধি অভিযানটি চালালেন না। ফ্যাসিবাদের দুর্নীতিবাজ ও হিংস্র সহযোগীদের যার যার স্থানে বসিয়ে রেখে রাষ্ট্র পরিচালনা করা যে এক অসম্ভব কাজ, এই সহজ বিষয়টা ড. ইউনূস বুঝলেন না। অথচ দায়িত্ব নিয়েই তিনি অনায়াসে এই শুদ্ধি অভিযান চালাতে পারতেন।

দেশে-বিদেশে প্রফেসর ইউনূসের প্রশ্নাতীত গ্রহণযোগ্যতার বিষয়টি উপেক্ষা করা বাংলাদেশের কোনো কাগুজে বাঘের পক্ষেই সম্ভব নয়। তাই তিনি সময়মতো আবর্জনা সাফ করার উদ্যোগ নিলে তাকে বাধা দেওয়ার সাহস কোনো সচিব, রাজনীতিবিদ কিংবা জেনারেলের হতো না। দুর্ভাগ্যবশত সরকার পরিচালনার জন্য ড. ইউনূস এনজিও, বন্ধুবান্ধব, সাবেক সুবিধাবাদী আমলা ও হাসিনার আমলের কীটদুষ্ট আমলাতন্ত্রের ওপরই নির্ভর করলেন।

অবস্থাটা এমন দাঁড়িয়েছে যে, প্রফেসর ইউনূস নিজেই সরকারের অনভিজ্ঞতা স্বীকার করে নিতে বাধ্য হচ্ছেন। ফলে অধীনস্থ সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তারা এখন তারই সরকারকে রীতিমতো তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে জনসমক্ষে বলে বেড়াচ্ছে, এভাবে নাকি আর চলতে পারে না। আমার স্মরণে আছে, স্বৈরাচারী জেনারেল এরশাদ আশির দশকের প্রারম্ভে রাষ্ট্রপতি সাত্তারের কাছ থেকে ক্ষমতা কেড়ে নেওয়ার ঠিক আগে মিডিয়ায় এ-জাতীয় হুমকি দিতেন।

‘এভাবে আর চলতে পারে না’ বয়ানের অর্থটা এবার একটু বোঝার চেষ্টা করা যাক। ১৫ বছরের বেশি সময় ধরে হাসিনার ফ্যাসিবাদের ডাকাততন্ত্র বাংলাদেশে চলার পর মাত্র পাঁচ মাসের মধ্যে কেউ যদি বলে, ‘এভাবে আর চলতে পারে না,’ তাহলে তার নিয়ত নিয়ে প্রশ্ন করাই যেতে পারে। আমরা জানি, রাজনীতিবিদরা নানারকম কথা দলীয় স্বার্থে বলে থাকেন।

তাছাড়া বিএনপি ও জামায়াতসহ সাবেক আমলের বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো ১৫ বছরের পুরোটা সময়কাল যার যার সাধ্যমতো রাজপথে লড়াই করেছে। সেই লড়াইয়ে তাদের হাজার হাজার নেতা-কর্মী শহীদ হয়েছেন। সরকারের কর্মকাণ্ড নিয়ে তাদের অভিমত দেওয়ার সম্পূর্ণ অধিকার আছে। কিন্তু যে সামরিক ও বেসামরিক আমলাতন্ত্র হাসিনাকে দানব হয়ে উঠতে সর্বাত্মক সহযোগিতা করেছে, তাদের কাছ থেকে জাতির কোনো জ্ঞান নেওয়ার প্রয়োজন নেই।

ad
আমরা এত তাড়াতাড়ি নিশ্চয়ই ভুলে যাইনি যে, দুর্নীতিবাজ আমলারা শেখ হাসিনার সব দুষ্কর্মকে চোখ বুজে শুধু সমর্থনই দেননি, তারা সর্বপ্রকারে ফ্যাসিবাদের সুবিধাভোগীও ছিলেন। ছাত্র-জনতার মহান বিপ্লবেও আমলাদের গণবিরোধী চেহারাই বারবার ফুটে উঠেছে। রাষ্ট্র রসাতলে গেলেও তারা হাসিনার পদলেহন করে পদপদবি ও অর্থবিত্ত বাগিয়েছেন।

অন্যদিকে সামরিক অফিসাররা আয়নাঘর তৈরি এবং ভিন্ন মতের নাগরিকদের গুম করার মতো ভয়ংকর মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িয়েছেন। তারা দেশরক্ষার শপথ নিয়েও চোখের সামনে দেশের সার্বভৌমত্ব দিল্লির পায়ে সমর্পিত হতে দিয়েছেন। শুধু ব্যক্তিস্বার্থে জেনারেল সাহেবরা সব ধরনের অনাচার দেখেও নীরব থেকেছেন।

জুলাই বিপ্লবের প্রাথমিক পর্যায়ে তারাও হাসিনার পক্ষেই ছিলেন। বিপ্লবের চূড়ান্ত সময়ে সামরিক বাহিনীর ছাত্রদের বুকে গুলি না চালানোর সিদ্ধান্ত অবশ্যই ফ্যাসিবাদের পতনে ইতিবাচক ভূমিকা রেখেছে। সে কারণে আরো প্রাণহানি এড়ানো গেছে এবং সেনাবাহিনী অবশ্যই প্রশংসা পেতে পারে। তবে আমাদের প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, জনগণের পক্ষে এই বিলম্বিত সিদ্ধান্ত গ্রহণও জুনিয়র অফিসারদের চাপেই সিনিয়রদের নিতে হয়েছে।

বিপ্লব সফল হওয়ার পর সিনিয়র সেনা অফিসারদের একক সিদ্ধান্তে পুলিশ ও আওয়ামী লীগের চিহ্নিত খুনি ও ডাকাতদের প্রথমে ক্যান্টনমেন্টে আশ্রয় দেওয়া এবং পরে তাদের পালিয়ে যেতে সহায়তা করা প্রকৃতপক্ষে বিপ্লবের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়ার শামিল। জেনারেল মুজিবের মতো একজন বিতর্কিত সেনা কর্মকর্তা কেমন করে ক্যান্টনমেন্টের ভেতর থেকে পালালেন, তার জবাব জানা আমাদের অধিকার।

সেনা কর্তৃপক্ষ আজ পর্যন্ত আমাদের জানায়নি যে, তাদেরই ঘোষণা অনুযায়ী ক্যান্টনমেন্টে আশ্রয়প্রাপ্ত ভাগ্যবান ৬২৬ ফ্যাসিবাদী খুনি ও ডাকাত কারা ছিল, কখন কীভাবে পালিয়েছে। এখন যখন দেখতে পাচ্ছি, অধিকাংশ পলাতক ভারতে আশ্রয় নিয়ে দেশবিরোধী কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হয়েছেন, তখন যারা খুনি ও ডাকাতদের পলায়নে সাহায্য করেছিলেন তাদের নিয়ত সম্পর্কে সন্দেহ জাগাটাই স্বাভাবিক।

সুতরাং জেনারেল অথবা সচিব, প্রজাতন্ত্রের যে কর্মচারীই হোক না কেন, বর্তমান প্রেক্ষাপটে তার একমাত্র কাজ দায়িত্বের সীমানার মধ্য থেকে ইউনূস সরকারের আইনানুগ নির্দেশ পালন। রাষ্ট্র ভবিষ্যতে কীভাবে চলবে, সে বিষয়টি সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যকার আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে নির্ধারিত হওয়াটাই বাঞ্ছনীয়।

প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের এসব বিষয়ে চুপ থাকা সবার জন্যই মঙ্গলকর হবে। ভারতও হঠাৎ করেই বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক সরকার দেখার জন্য উদগ্রীব হয়ে উঠেছে। ঢাকায় এক ভয়ংকর ফ্যাসিস্ট শাসককে দেড় দশক লালনপালন করে দেশটির হঠাৎ বাংলাদেশের গণতন্ত্রের জন্য এই মায়াকান্না শোভা পায় না। ভারত সরকার, সেনাপ্রধান, সাবেক কূটনীতিক ও মিডিয়ার বক্তব্যকে কাকতালীয় ভাবার কোনো কারণ নেই।

‘এভাবে চলতে পারে না’ গ্রুপের সঙ্গে ভারতের বয়ানের মিল দেখে বাংলাদেশের দেশপ্রেমিক জনগোষ্ঠীর সতর্ক হওয়া উচিত। ভারতীয় বয়ান বাংলাদেশের ক্ষমতাবান আমলাকুল কিংবা রাজনীতিবিদদের কণ্ঠে উচ্চারিত হলে তারা ফ্যাসিবাদ ও ভারতীয় হেজেমনির দালাল হিসেবে বিবেচিত হতে পারেন।

ড. ইউনূস সরকারের সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে তাদের অন্তর্নিহিত দুর্বলতা। এই দুর্বলতা সরকারের অন্তর্বর্তী নামকরণ ও উপদেষ্টা নির্বাচন থেকেই শুরু হয়েছিল। সরকার পরিচালনায় অনেক ক্ষেত্রেই উপদেষ্টারা যথাযথ বলিষ্ঠতা ও প্রজ্ঞা দেখাতে না পারায় ক্ষমতাপ্রত্যাশী রাজনৈতিক দলের চাপ সরকারের ওপর উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেয়েছে।

ছাত্রদেরও সরকারের অংশ না হয়ে বাইরে থেকে একটি অত্যন্ত শক্তিশালী ‘প্রেশার গ্রুপ’ হিসেবে ভূমিকা রাখলে আজ কিংস পার্টির বিতর্ক উঠত না। তাদের যেহেতু রাজনৈতিক অভিলাষ ছিল, তাই সরকারের সঙ্গে কোনো প্রত্যক্ষ সম্পর্ক না রাখাটাই সমীচীন হতো। ছাত্র-মনোনীত উপদেষ্টারা নতুন রাজনৈতিক দল গঠনের আগে সরকার ছাড়ার ঘোষণা দিলেও কিংস পার্টির বিতর্ক এত সহজে মিটবে বলে মনে হচ্ছে না।

যদিও কিংস পার্টির তর্ক যারা তুলছেন, তাদের নৈতিক অবস্থান নিয়েও প্রশ্ন উঠতে পারে। আমি মনে করি, ছাত্ররা শুধু সরকারের বাইরের ‘প্রেশার গ্রুপ’ হিসেবে ভূমিকা রাখলে বিপ্লব-পরবর্তী সরকার আরো বলিষ্ঠতার সঙ্গে রাষ্ট্রীয় কাজকর্ম করতে পারত। আনসার লীগের সচিবালয়ে অভিযানসহ বিভিন্ন গোষ্ঠীর রাস্তাঘাটে অরাজকতা ঠেকাতে বৈষম্যবিরোধী এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের বারবার ছুটে যাওয়া প্রমাণ করেছে যে, জুলাই বিপ্লবে অংশগ্রহণকারীদের সমন্বয়ে গঠিত ‘প্রেশার গ্রুপ’ সরকারের অংশ না হয়েও সহায়ক শক্তি হিসেবে ভূমিকা রাখতে পারে।

যাই হোক, কিংস পার্টি বিতর্কের অবসান হওয়া জরুরি হয়ে পড়েছে। ছাত্রদের রাজনৈতিক দল গঠন অথবা সরকারে অবস্থানের বিষয়েও দ্রুত নিষ্পত্তি হওয়া প্রয়োজন। অন্যদিকে ব্যাপক শুদ্ধি অভিযানের সুযোগ হারালেও সরকারে গতিশীলতা আনার জন্য সামরিক ও বেসামরিক আমলাতন্ত্রের গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় ফ্যাসিবাদ ও ভারতীয় হেজেমনির দোসর এবং প্রচ্ছন্ন সমর্থকদের অনতিবিলম্বে সরিয়ে দেওয়া উচিত।

ক্ষমতার একাধিক কেন্দ্র রয়েছে, জনমনে এমন বিভ্রান্তির অবসান করতে হলে সরকার পরিচালনায় বলিষ্ঠতা দেখাতে হবে। ‘আগেই ভালো ছিল’ অথবা ‘এভাবে চলতে পারে না’ জাতীয় ফ্যাসিবাদ-পক্ষীয় বয়ানকে মোকাবিলা করতে হলে ড. ইউনূসকে যেকোনো অরাজকতার বিরুদ্ধে স্বচ্ছতার সঙ্গে প্রয়োজনীয় কঠোরতা দেখাতে হবে।

প্রধান উপদেষ্টার পদ গ্রহণের পর থেকে ভারত প্রশ্নে তিনি যথেষ্ট দৃঢ়তার পরিচয় দিয়েছেন। আশা করি, একই রকম দৃঢ়তা নিয়ে তিনি বাংলাদেশকে যুক্তিসংগত সময়ের মধ্যে গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় ফিরিয়ে নিতে যাবতীয় কার্যক্রম দ্রুততার সঙ্গে সম্পন্ন করবেন। তাকে স্মরণে রাখতে হবে, সেই পর্যন্ত সরকারের সফলতা ও ব্যর্থতার সব দায়ভার একমাত্র তারই কাঁধে। (দৈনিক আমার দেশ)