সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে অন্যায় সাজা দিয়ে পুরস্কৃত হয়েছেন পাঁচ বিচারপতি। তাদের মধ্যে তিন জেলা ও দায়রা জজ হয়েছেন হাইকোর্টের বিচারপতি। আর দু’জন হাইকোর্টের বিচারক পদোন্নতি পেয়ে গেছেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে। জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট ও জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্টের দুটি সাজানো মামলায় এই পাঁচ বিচারক প্রলোভনে পড়ে ফরমায়েশি রায় দেন। এর ফলে তিনবারের একজন সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও দেশের শীর্ষ রাজনীতিক প্রবীণ বয়সে কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে বন্দিজীবনের নিষ্ঠুরতা ভোগ করেছেন।
এ প্রতিবেদনটি প্রকাশিত হয়েছে দৈনিক আমার দেশ পত্রিকায়। পাঠকদের জন্য হবুহু তুলে ধরা হলো--
খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে এ দুটি সাজানো মামলা সম্পর্কে অনুসন্ধান করতে গিয়ে এ তথ্য পাওয়া গেছে। আইন মন্ত্রণালয় থেকে পাওয়া তথ্যমতে, পতিত শেখ হাসিনার সরকার বেআইনি নির্দেশ পালন করে অভাবনীয় পুরস্কারে ভূষিত হওয়া পাঁচজন হলেন- বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম, বিচারপতি মোহাম্মদ নুরুজ্জামান (ননী), বিচারপতি আবু আহমেদ জমাদার, বিচারপতি কামরুল হোসেন মোল্লা ও বিচারপতি মো. আখতারুজ্জামান।
সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল অ্যাডভোকেট এ জে মোহাম্মদ আলী (মরহুম) ও সিনিয়র আইনজীবী অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেনের (মরহুম) নেতৃত্বে একদল প্রতিথযশা আইনজীবী এ সাজানো মামলা দুটি আদালতে চ্যালেঞ্জ করেন। আদালতে উপস্থাপিত তাদের বক্তব্য ছিল- ‘জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট ও জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্টসংক্রান্ত মামলা দুটি খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যেই করেছিল দুদক। এক্ষেত্রে হাসিনা সরকারের প্রতিহিংসার শিকার হয়েছেন তিনি। তারা বলেন, ‘যেখানে লেনদেনই হয়নি, সেখানে কী করে দুর্নীতি হয়?’ আদালতে সেদিন জবানবন্দিতে খালেদা জিয়া বলেছিলেন, জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট ও জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট গঠন, এর তহবিল সংগ্রহ, ট্রাস্ট পরিচালনা এবং কোনো লেনদেনের সঙ্গে তার কোনো সংশ্লিষ্টতা ছিল না। প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে তিনি পদের প্রভাব খাটাননি। রাজনীতি থেকে দূরে রাখতেই অনুমাননির্ভর, কল্পিত অভিযোগে তাকে জড়ানো হয়েছে।
আইনজীবীরা আদালতকে জানিয়েছিলেন, ‘এ মামলা দুটির পক্ষে দুদক এতিম তহবিলের যে নথিপত্র জমা দিয়েছে, তা হাতে লেখা, ঘষামাজা করা এবং স্বাক্ষরবিহীন। কোনো মূল নথি পাওয়া যায়নি। আইনকানুনের তোয়াক্কা না করেই ছায়ানথি সৃজন করা হয়েছে। মামলার ৩২ জন সাক্ষীর কেউই খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে বলেননি। বানোয়াট তথ্যের ভিত্তিতে করা এ মামলা সাজানো। বরং সোনালী ব্যাংকে রাখা এফডিআরে ২ কোটি টাকা সুদাসলে ৬ কোটি হয়েছে। জাল নথিপত্র তৈরি করে মামলাটি করা হয়েছে। জাল নথিপত্র তৈরি ও মিথ্যা সাক্ষ্য দেওয়ার অভিযোগে তদন্তকারী কর্মকর্তাসহ ছয় জন সাক্ষীর বরং শাস্তি হওয়া উচিত। অনুসন্ধানে জানা যায়, বেশ কয়েকজন সাক্ষীকে অবসর থেকে এনে প্রধানমন্ত্রীর অফিসে চাকরিও দেওয়া হয়, যাতে তারা সরকার যা বলে তা-ই সাক্ষ্য দেন।
আইন মন্ত্রণালয়, আদালত ও অন্যান্য সূত্র থেকে পাওয়া তথ্যে জানা যায়, জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলা ও জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলায় মহানগর বিশেষ দায়রা জজ আদালত ১২ বছরের সাজা দেয়। হাইকোর্ট এ সাজার মেয়াদ আরও পাঁচ বছর বাড়িয়ে ১৭ বছর করে দেয়। পুরো বিচার প্রক্রিয়াকে প্রহসনের নিকৃষ্টতম উদাহরণ হিসেবে দেখছেন আইনবিশেষজ্ঞরা। আর সাজা দেওয়ার ক্ষেত্রে আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন হওয়ায় গভীর বিস্ময় প্রকাশ করছেন অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদ। আইন মন্ত্রণালয়ের বিচার বিভাগের ঊর্ধ্বতন একাধিক কর্মকর্তা ও সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র পাঁচজন আইনজীবী আমার দেশকে জানিয়েছেন, তৎকালীন শেখ হাসিনার সরকার পছন্দের লোকদের বিচারকের আসনে বসিয়ে ও পুরস্কারের প্রলোভন দেখিয়ে এ ফরমায়েশি রায় আদায় করে নিয়েছে। এক্ষেত্রে পাঁচ বিচারপতিই অত্যন্ত নির্লজ্জভাবে প্রচলিত আইনের লঙ্ঘন করে বেগম খালেদা জিয়ার মামলাকে ব্যক্তিগত স্বার্থ হাসিলে ব্যবহার করেছেন। বিচারের ইতিহাসে এমন কলঙ্কজনক অধ্যায় রচনা করায় আলোচিত এ পাঁচ বিচারপতিকে শাস্তির আওতায় আনার দাবিও জানান আইনজীবী ও বিচার বিভাগের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।
উচ্চ আদালত পরবর্তী সময়ে একটি মামলা বাতিল করে অভিযোগ থেকে বেগম খালেদা জিয়াকে পুরোপুরি অব্যাহতি দিয়েছে। অপর মামলাটিও বাতিলের বিষয়ে উচ্চ আদালত লিভ টু আপিল গ্রহণ করে স্থগিতাদেশ জারি করেছে।
খালেদা জিয়াকে দোষী সাব্যস্ত করেন জমাদার
আইন মন্ত্রণালয়ের আইন ও বিচার বিভাগ সূত্র জানিয়েছে, আবু আহমেদ জমাদার ২০০৯ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত আইন, বিচারক ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপসচিব পরে যুগ্মসচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
খালেদা জিয়া এবং আমার দেশ সম্পাদক মাহমুদুর রহমানকে শাস্তি দেওয়ার নির্দেশনা দিয়ে তাকে ঢাকার বিশেষ জজ আদালতের বিচারক হিসেবে পদায়ন করা হয়। আদালতে পদায়নের আগে আইনমন্ত্রীর দপ্তরে তাকে নিয়ে একাধিক বৈঠক হয় বলে আমার দেশকে নিশ্চিত করেছেন আইন মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন একজন কর্মকর্তা।
২০১৫ সালের জুনে ঢাকার বিশেষ জজ আদালত-৩-এর বিচারক হিসেবে জমাদার ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলা ও জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলার শুনানির তারিখ নির্ধারণ করেন। ২০১৬ সালের ডিসেম্বরে বিশেষ জজ আদালত-৩-এ খালেদা জিয়া দোষী সাব্যস্ত করে আদেশ দেয়।
আবু আহেমদ জমাদার বিচারের সব রীতি ও রেওয়াজ ভঙ্গ করে অতি দ্রুততার সঙ্গে খালেদা জিয়াকে শাস্তি দিতে মামলার অবিরত শুনানি করেন। আদালতেই তার বিরুদ্ধে অনাস্থা পেশ করেন খালেদা জিয়ার আইনজীবীরা।
শুনানিকালে খালেদা জিয়ার আইনজীবী ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন বিচারক আবু আহমেদ জমাদারকে উদ্দেশ্য করে বলেন, ‘আপনি এ মামলায় খালেদা জিয়াকে শাস্তি দিয়ে হাইকোর্টের বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ পাবেন, সরকারের কাছ থেকে এমন নিশ্চয়তা নিয়েই আইন মন্ত্রণালয় থেকে এ আদালতে এসে বিচারকের আসনে বসেছেন। হাইকোর্টের বিচারপতি হিসেবে আমরা আপনাকে স্বাগত জানাই। কিন্তু দয়া করে আইনের ব্যত্যয় ঘটাবেন না, বিচারব্যবস্থাকে কলুষিত করবেন না। ব্যক্তিগত লাভালাভের প্রলোভনে পড়ে আপনি তিনবারের প্রধানমন্ত্রীকে তুচ্ছ মামলায় সাজা দেওয়ার জন্য উঠেপড়ে লেগেছেন।’ ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকনের এ বক্তব্যের জবাবে বিচারক আবু আহমেদ জমাদার বলেন, ‘পুরস্কার পাওয়ার জন্য নয়, আমি যত দ্রুত এখান থেকে যেতে পারি ততই রেহাই।’
বিচারক আবু আহমেদ জমাদারের বিরুদ্ধে তথ্যপ্রমাণসহ হাইকোর্টে আবেদন করেন আইনজীবীরা। হাইকোর্ট অভিযোগ আমলে নিয়ে খালেদা জিয়ার এ মামলা আবু আহমেদ জমাদারের আদালত থেকে স্থানান্তর করে দেয়। তবে সরকার তাকে প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী, হাইকোর্টের বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ দিয়ে পুরস্কৃত করে।
বেগম খালেদা জিয়াকে আদালতে দোষী সাব্যস্ত করার বিষয়ে আমার দেশের পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা হয় বিচারপতি আবু আহমেদ জমাদারের সঙ্গে। একাধিকবার ফোন করলেও তিনি রিসিভ করেননি। বেগম খালেদা জিয়াকে আইনবহির্ভূতভাবে দোষী সাব্যস্ত করার বিষয়ে মতামত চেয়ে তাকে মেসেজ দেওয়া হয়। তিনি মেসেজটি দেখলেও কোনো জবাব দেননি।
গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন কামরুল হোসেন : আইন মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, বিগত আওয়ামী লীগ সরকার ২০০৯ সালের ২৮ এপ্রিল কামরুল হোসেন মোল্লাকে জেলা ও দায়রা জজ হিসেবে পদোন্নতি দেয়। ২০১৪ সালে তাকে সিনিয়র জেলা জজ করা হয়। ২০১৫ সালের জুন মাসে মিরপুরের একটি বাস পোড়ানোর মামলায় বিএনপির ৩৩ কেন্দ্রীয় নেতার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে সরকারের আস্থা অর্জন করেন ঢাকার বিশেষ জজ আদালতের বিচারক মোল্লা। এরই সূত্র ধরে সরকার তার ওপর ন্যস্ত করে বিএনপি চেয়ারপারসনের বিরুদ্ধে করা জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলা ও জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলা দুটির বিচার নিষ্পত্তির দায়িত্ব ন্যস্ত করে।
২০১৬ সালের মে মাসে বিচারক কামরুল হোসেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া এবং দুই মামলায় আরও ২৭ জনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন। বিচারক আবু আহমেদ জমাদারের হাতে এ মামলা দুটি ন্যস্ত হওয়ার আগ পর্যন্ত তিনি এ মামলার শুনানি গ্রহণ করেন। ২০১৮ সালের ৩১ মে সরকার কামরুল হোসেন মোল্লাকে হাইকোর্টের বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ দেয়। বিচারপতি হিসেবে নিয়োগের পর পরই তিনি গোপালগঞ্জে শেখ মুজিবের কবর জিয়ারত করে সংবাদপত্রে খবরের শিরোনাম হন।
খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির বিষয়ে কোনো অনিয়ম হয়েছে কি না- জানতে আমার দেশ যোগাযোগ করে বিচারপতি কামরুল হোসেন মোল্লার সঙ্গে। টেলিফোনে তিনি আমার দেশকে জানান, ‘এ বিষয়ে আমি কোনো কথা বলতে পারি না। আপনাদের কোনো বিষয়ে জানার থাকলে সংশ্লিষ্ট মামলার আইনজীবীদের সঙ্গে যোগাযোগ করুন।’
১২ বছরের সাজা দেন আখতারুজ্জামান : কামরুল হোসেন মোল্লা ও আবু আহমেদ জমাদারের পর খালেদা জিয়ার মামলা দুটিতে চূড়ান্ত রায় ঘোষণার দায়িত্ব পান বিচারক আখতারুজ্জামান। আইন মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, ২০১৪ সালের ১৫ জুন তিনি জেলা ও দায়রা জজ হিসেবে পদোন্নতি লাভ করেন। ঢাকার বিশেষ জজ আদালত-৫-এর বিচারক হিসেবে তিনি ২০১৮ সালের ৩ অক্টোবর জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় বেগম খালেদা জিয়াকে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দেন। পাশাপাশি একই মামলায় বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানসহ অন্য আসামিদের বিরুদ্ধে ১০ বছর করে কারাদণ্ড ও ২ কোটি ১০ লাখ টাকা করে জরিমানার আদেশ দেন। রায়ের সময় বেগম খালেদা জিয়া আদালতে উপস্থিত ছিলেন এবং এখান থেকেই তাঁকে কারাগারে পাঠানো হয়। রায়ে বিস্ময় প্রকাশ করেন খালেদা জিয়ার আইনজীবী খ্যাতনামা ফৌজদারি আইনবিশেষজ্ঞ ও সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সাবেক সভাপতি অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন বিচারক আখতারুজ্জামানকে উদ্দেশ করে বলেন, ‘আপনি হয়তো এ রায়ের ফলে হাইকোর্টের বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ পাবেন। কিন্তু বিচারের ইতিহাসে আপনার এ রায় কলঙ্কজনক অধ্যায় হয়ে যুগ যুগ ধরে লিপিবদ্ধ থাকবে। রায় ঘোষণার পর ক্ষোভ প্রকাশ করে আদালতে অপর সিনিয়র আইনজীবী ব্যারিস্টার এ জে মোহাম্মদ আলী বলেন, ‘মাননীয় আদালত, আপনি ক্ষুদ্র ব্যক্তিস্বার্থে আজ তিনবারের প্রধানমন্ত্রী ও দেশের একজন সিনিয়র সিটিজেনকে একটি মিথ্যা, ভিত্তিহীন ও বানোয়াট মামলায় কারাগারে পাঠাচ্ছেন। আমার আশঙ্কা হয়, এ রায় আপনাকে একদিন শুধু ইতিহাসের কাঠগড়াতেই নয়, আদালতের কাঠগড়াতেও দাঁড় করাবে।’
একই বিচারক কিছুদিন পর ২৯ অক্টোবর জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলায় বেগম খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে সাত বছরের কারাদণ্ড দেন। এর রায় ঘোষণার সময় খালেদা জিয়া আদালতে বন্দি ছিলেন। সরকার তাকে আদালতে হাজির করেনি।
দুই মামলায় বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াকে মোট ১২ বছরের কারাদণ্ড দেওয়ার পর ২০১৯ সালের ২১ অক্টোবর আওয়ামী লীগ সরকার আখতারুজ্জামানকে হাইকোর্টের বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ দেয়। বেগম খালেদা জিয়াকে সাজা দেওয়ার বিষয়ে বিচারপতি আখতারুজ্জামানের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়। তবে তার ফোনটিতে সংযোগ নেওয়া সম্ভব হয়নি।
সাজা বাড়িয়ে ইনায়েতুর রহিম আপিল বিভাগে পদোন্নতি পান : বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিমের বাবা এম আব্দুর রহিম বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের রাজনীতিবিদ ও দিনাজপুর-৩ আসনের সংসদ সদস্য ছিলেন। ছোট ভাই ইকবালুর রহিমও আওয়ামী লীগের দলীয় এমপি ও সংসদের হুইপ।
বিচারপতি হিসেবে নিযুক্ত হওয়ার আগে ইনায়েতুর রহিম ২০০৫ সালে আওয়ামী লীগ প্যানেল থেকে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সম্পাদক নির্বাচিত হন। আওয়ামী লীগ সরকার তাকে ২০০৯ সালে তিনি অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল হিসেবে দায়িত্ব নিয়োগ দেয়। আশির দশকে ইনায়েতুর রহিম বাকশাল ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন।
দুটি মামলায় ঢাকা মহানগর বিশেষ দায়রা জজ আদালতের দেওয়া দুই মামলায় ১২ বছরের সাজার বিরুদ্ধে বেগম খালেদা জিয়া হাইকোর্টে আপিল করেন। বিচার ইতিহাসের সব রীতিনীতি ভঙ্গ করে বিচারপতি এনায়েতুর রহিমের নেতৃত্বাধীন হাইকোর্টের ডিভিশন বেঞ্চ খালেদা জিয়ার সাজার মেয়াদ আরও পাঁচ বছর বাড়িয়ে দেয়। এ রায় ঘোষণার পর সরকার তাকে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের বিচারক হিসেবে নিয়োগ দেয়। কিছুদিন ভারপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতির দায়িত্বও পালন করেন এম এনায়েতুর রহিম।
বিচারপতি ইনায়েতুর রহিমের এ ভূমিকাকে ‘অতিমাত্রার অ্যাগ্রেসিভ’ বলে অভিহিত করেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবীরা। তাদের মতে, ‘বিচারপতি ইনায়েতুর রহিম সুপ্রিম কোর্টের ইতিহাসে এক কলঙ্কজনক ইতিহাসের জন্ম দিয়েছেন। যুগ যুগ ধরে বিচার বিভাগকে এর দায় বহন করতে হবে।’
বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিমের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তার ফোন বন্ধ পাওয়া যায়। গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পতন ও পলায়নের পর তিনিও আত্মগোপনে চলে যান। আত্মগোপনে থেকেই ই-মেইলে তিনি আইন মন্ত্রণালয়ে পদত্যাগপত্র পাঠান বলে মন্ত্রণালয়ের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা আমার দেশকে নিশ্চিত করেন।
মামলা নিষ্পত্তির ব্যবস্থা করে আপিল বিভাগের বিচারপতি হন ননী : আইনজীবীরা বিচারিক্ আদালতে খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে মামলার কার্যক্রমের ওপর স্থগিতাদেশ ও বাতিল চেয়ে হাইকোর্টে আবেদন করেন। হাইকোর্ট প্রথমদিকে এ আবেদন গ্রহণ করে রুল জারি করে। পরবর্তীতে প্রধান বিচারপতি এ আবেদন পুনরায় নিষ্পত্তির জন্য বিচারপতি মোহাম্মদ নুরুজ্জামান ননীর নেতৃত্বাধীন ডিভিশন বেঞ্চে পাঠিয়ে দেন।
উভয়পক্ষের আইনজীবীদের শুনানি গ্রহণ শেষে বিচারপতি নুরুজ্জামান ননীর বেঞ্চ খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে হওয়া এ মামলাগুলোর স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার করে চূড়ান্ত রায়ের জন্য বিচারিক আদালতে পাঠিয়ে দেয়।
২০১৮ সালের ৯ অক্টোবর বিচারপতি নুরুজ্জামান ননীকে সরকার আপিল বিভাগের বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ দেয়। তিনি প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন আপির বিভাগের ফুল বেঞ্চে সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি চেম্বার জজেরও দায়িত্ব পালন করেন।
বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ লাভের আগে নুরুজ্জামান ননী ঢাকা আইনজীবী সমিতিতে আওয়ামী লীগ প্যানেল থেকে নির্বাচন করে সাধারণ সম্পাদক ও পরে সভাপতি হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন।
খালেদা জিয়ার মামলার বিচারের নিষ্পত্তির ব্যবস্থার বিষয়ে বিচারপতি নুরুজ্জামান ননী আমার দেশকে বলেন, বেগম খালেদা জিয়ার মামলা শুনানি না করতে আমি অনেক চেষ্টা করেছিলাম। প্রধান বিচারপতির দপ্তর থেকে আমার কাছে পাঠানো হয়েছে। শুনানিতে বিএনপির অনেক খ্যাতনামা আইনজীবী অংশ নিয়েছেন। আমি চেষ্টা করেছি, আইন ও ডিএলআরের সব রেফারেন্স পর্যালোচনা করে সিদ্ধান্ত দিতে। তা ছাড়া আমার রায়ই চূড়ান্ত ছিল না। তারপরও আপিল বিভাগ ছিল।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি আমার দেশকে বলেন, ‘আমি রাজনীতি ছেড়ে বিচারপতি হিসেবে শপথ নেওয়ার পর বিচার বিভাগের মর্যাদা রক্ষায় সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছি। আপিল বিভাগের বিচারক হওয়ার জন্য আমি কোনোদিন কারোর কাছে অনুরোধ করিনি। এখন কেউ যদি কিছু বলে থাকেন সে বিষয়ে আমার এ অবস্থায় কিছু বলার নেই।
ad
মামলার রায়ে উপদেষ্টা পরিষদের বিস্ময় : বিএনপি চেয়ারপারসন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে অতি তুচ্ছ মামলায় শাস্তি প্রদানকে ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের অতি নিম্নমানের ঘৃণ্য কাজ হিসেবে দেখছে অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদ। প্রতিহিংসার এক নির্লজ্জ উদাহরণ বলেও মনে করছেন বর্তমান সরকারের সংশ্লিষ্টরা। এ বিষয়ে আইন বিচার ও সংসদবিষয়ক উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল বলেছেন, ‘দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ও বিচার বিভাগ গত ১৫ বছরে ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের দাসে পরিণত হয়েছিল। খালেদা জিয়া ৩ কোটি টাকা এক জায়গায় রেখেছিলেন। একটা টাকাও সেখান থেকে তিনি আত্মসাৎ করেনি। বরং ৩ কোটি টাকা ৬ কোটি টাকা হয়েছে। ওই টাকা কেউ স্পর্শও করেনি। এই টাকা রাখার প্রক্রিয়াগত ভুলের কারণে তিনবারের প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়াকে ১০ বছরের জেল দিয়েছে দুদক ও বিচার বিভাগ মিলে। আর সারাদেশে শেখ হাসিনা বলে বেড়াতেন এতিমের টাকা নাকি খালেদা জিয়া আত্মসাৎ করেছেন।
ড. আসিফ নজরুল বলেন, গত ১৫ বছরে আমরা দেখেছি, ১০০ টাকার বালিশ নাকি ৪-৫ হাজার টাকায় কেনা হয়েছে। আমরা দেখেছি, ছয়টি ব্যাংক লুট হয়েছে। বাংলাদেশের একজন সাধারণ ব্যবসায়ী সিঙ্গাপুর সবচেয়ে বড় লোক হয়ে গেছে। আমরা দেখেছি ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রীর পিয়ন ৪০০ কোটি টাকার মালিক হয়েছে, এটা হাসতে হাসতে তিনি জাতির সামনে বলেছেন।
যা বলছেন ওই সময়ের দুদক আইনজীবী : খালেদা জিয়ার মামলায় আদালত ও দুদকের ভূমিকার বিষয়ে জানতে আমার দেশ কথা বলে সিনিয়র আইনজীবী অ্যাডভোকেট খোরশেদ আলম খানের সঙ্গে, যিনি ওই সময় দুদকের পক্ষে আদালতে খালেদা জিয়ার মামলায় শুনানি করেন। খোরশেদ আলম বলেন, ‘গত সরকারের সময় এ মামলা দুটিতে খালেদা জিয়ার সাজা হয়েছিল ঠিকই তবে, আমি যতটুকু জেনেছি কিছুদিন আগে একটি মামলা বাতিল হয়ে গেছে এবং আরেকটি মামলায় উচ্চ আদালত লিভ টু আপিল গ্রহণ করে নিম্ন আদালতের সব কার্যক্রম স্থগিত করেছে। আমি এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে চাই না। কারণ আমি এখন দুদকের সঙ্গে সম্পৃক্ত নই।’
৫ বিচারপতির পুরস্কার নিয়ে আইনজীবীরা যা বলছেন : শেখ হাসিনা তার পছন্দের বিচারকদের মাধ্যমে বেগম খালেদা জিয়াকে সাজা দেওয়ার আয়োজন করে ব্যক্তিগত প্রতিহিংসা চরিতার্থ করেছেন বলে মন্তব্য করেন সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন। আমার দেশকে তিনি বলেন, আমি প্রতিটি কোর্টেই এ মামলার শুনানিতে অংশ নিয়েছি। একজন আইনজীবী হিসেবে আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি, প্রত্যেক বিচারকের মিশন ছিল- বেগম খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানকে এ মিথ্যা মামলায় সাজা দিয়ে পদোন্নতি ও পদায়ন নিশ্চিত করা। আদালতে তারা প্রত্যেকে এ মামলার শুনানিতে সরকার পক্ষে অতি নিম্নমানের দালালি ও আসামিদের বিরুদ্ধে অতিমাত্রার অ্যাগ্রেসিভ ভূমিকা পালন করেছেন।
বেগম খালেদা জিয়াকে সাজা প্রদানে বিচারিক আদালতের তিন বিচারক ও হাইকোর্টের দুই বিচারপতি অন্যায্য আচরণ করেছেন বলে আমার দেশকে জানিয়েছেন সুপ্রিমকোর্ট আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক ব্যারিস্টার রুহুল কুদ্দুস কাজল। তিনি বলেন, বিএনপি চেয়ারপারসনের বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া মামলাগুলো ছিল রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। আদালত সরকারের নির্দেশ পালন করে পুরস্কৃত হয়েছে।
মামলায় পাঁচ বিচারকের ভূমিকা নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী ব্যারিস্টার কায়সার কামাল আমার দেশকে বলেন, ‘আওয়ামী লীগের দলীয় আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে এবং ব্যক্তিগত স্বার্থ চরিতার্থ করার লোভে বিচারকরা বেগম খালেদা জিয়ার ওপর যে অন্যায় ও অবিচার করেছেন, তা শুধু আমাদের দেশ নয়, গোটা বিশ্বে বিরল।
তিনি বলেন, বিশ্বের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে আমরা দেখতে পাই বিচারের নামে যারা অবিচার করেছে তাদের আইনের আওতায় এনে শাস্তির ব্যবস্থা করা হয়েছে। আমাদের দেশেও এমন দৃষ্টান্ত স্থাপন হবে বলে আশা করছি।
ঢাকা আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি এবং বেগম খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের মামলার আইনজীবী অ্যাডভোকেট মাসুদ আহমেদ তালুকদার আমার দেশকে বলেন, ‘নিরপেক্ষ ও প্রভাবমুক্ত বিচার হলে খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের সাজা তো দূরের কথা আদালত মামলাই আমলে নিত না। বিচার বিভাগ ও দুদক বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের দাসে পরিণত হওয়ায় ভুয়া মামলায় তাদের সাজা দিয়েছে। এ সাজা দিয়েই বিচারকরা সরকারের পুরুস্কার হিসেবে পদ ও পদবি বাগিয়ে নিয়েছেন। শুনানিকালে আদালতের বিচারকদের নির্লজ্জ ভূমিকা আমরা তাদের প্রকাশ্যেই বলেছি।
সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও সিনিয়র আইনজীবী ব্যারিস্টার বদরুদ্দোজা বাদল আমার দেশকে বলেন, দুর্নীতি দমন কমিশন এখন বলছে বিগত শেখ হাসিনার সরকারের নির্দেশে বেগম খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে মামলা ও অভিযোগপত্র দিয়েছে। এটা দিবালোকের মতো পরিষ্কার, বেগম খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানকে রাজনীতি থেকে দূরে রাখার জন্য শেখ হাসিনার নির্দেশে এ মিথ্যা মামলায় তাদের সাজা দেওয়া হয়েছে। যে বিচারকই এ মামলার নথিতে হাত দিয়েছেন, তিনিই সরকারের কাছ থেকে অবৈধ ও ‘আনডিউ’ সুবিধা পেয়েছেন। তিনি বলেন, শুনানিতে আমরা মামলার মেরিট তুলে ধরে আদালতে প্রকাশ্যেই এসব কথা বলেছি।
তথ্যসূত্র: আমার দেশ