বাংলাদেশে সাম্প্রতিক সময়ে সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতনের নানা অভিযোগ এবং এরপর সনাতন জাগরণের মঞ্চের মুখপাত্র চিন্ময় কৃষ্ণ দাসের গ্রেফতারকে কেন্দ্র করে প্রতিবেশী ভারতের সাথে ‘কূটনৈতিক সম্পর্কের দৃশ্যত অবনতি’ ঘটেছে।
খবর বিবিসি বাংলার।
এর জের ধরে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে পাল্টাপাল্টি বিবৃতি, সামাজিক মাধ্যমে পতাকা অবমাননার ছবি প্রচারসহ ভারত ও বাংলাদেশে পরস্পরবিরোধী আগ্রাসী প্রচারণা, কলকাতায় বাংলাদেশ উপহাইকমিশনের সামনে বিক্ষোভ এবং বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায় সংখ্যালঘু কিংবা তাদের উপাসনালয়ে ভাংচুর-হুমকির অভিযোগ উঠে আসছে।
সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নেতৃস্থানীয় কোন কোন ব্যক্তি এবং বিশ্লেষকদের কেউ কেউ প্রশ্ন তুলতে শুরু করেছেন যে, বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের নিয়ে যেসব ঘটনা ঘটছে তা অভ্যন্তরীণ ও কূটনৈতিকভাবে সরকার ঠিকভাবে সামাল দিতে পারছে কি না?
সরকার কী পদক্ষেপ নিতে পারতো কিংবা পরিস্থিতি সামাল নিতে যথাযথ পদক্ষেপ না নেয়া হলে তার প্রভাব কেমন হবে অর্থাৎ ভবিষ্যতে কেমন পরিস্থিতির উদ্ভব হতে পারে, সেসব আলোচনাও শুরু হয়েছে।
যদিও জাতিসংঘের সংখ্যালঘু বিষয়ক ফোরামে বাংলাদেশ বলেছে, বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতন নিয়ে মিথ্যা তথ্য ছড়ানো হচ্ছে এবং দেশের সংখ্যালঘুদের ওপর পদ্ধতিগত কোন হামলার ঘটনা ঘটেনি।
ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর দেশটির পার্লামেন্টে বলেছেন, সংখ্যালঘুদের মন্দির ও ধর্মীয় স্থানগুলোতেও হামলার খবর পাওয়া গেছে। ঘটনাগুলো গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছে ভারত। এ নিয়ে বাংলাদেশ সরকারের কাছে উদ্বেগ জানানো হয়েছে।
বাংলাদেশ সরকারের উপদেষ্টা আসিফ নজরুল তার ফেসবুক পাতায় সংখ্যালঘু বিষয়ে ভারতের অবস্থানকে 'দ্বিচারিত' আখ্যায়িত করে এর নিন্দা করেছেন।
পরিস্থিতি কীভাবে এতদূর গড়ালো
বাংলাদেশের হিন্দু সম্প্রদায়ের নেতৃস্থানীয় একজন ব্যক্তি বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, স্বাধীনতার পর থেকেই বাংলাদেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায় বিভিন্ন সময়ে আক্রমণের শিকার হয়েছে এবং প্রতিটি সরকারের আমলেই ধারাবাহিকভাবে তা চলে আসছে।
“এবার জুলাইয়ের শুরু থেকেই দেশের নানা জায়গায় বিচ্ছিন্ন কিছু ঘটনা ঘটছিলো, যা এখনো চলছে। তবে দুর্গাপূজার সময় ব্যাপক উদ্বেগ তৈরি হলেও রাষ্ট্র তা সামাল দিয়েছে। চট্টগ্রামে আইনজীবী হত্যার পরেও রাষ্ট্র ও সরকার পরিস্থিতির অবনতি ঠেকাতে পেরেছে। অর্থাৎ সরকার চাইলে এটি সম্ভব। কিন্তু সব ক্ষেত্রে তা হচ্ছে না,” বলছিলেন তিনি।
‘নিরাপত্তা জনিত’ কারণে তিনি তার নাম ও পরিচয় এই রিপোর্টে ব্যবহার না করার অনুরোধ করেছেন।
গণআন্দোলনের মুখে পাঁচই অগাস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর আটই অগাস্ট অন্তর্বর্তী সরকার গঠন হয়েছিলো। সরকার বিহীন এই তিনদিনে দেশের বিভিন্ন স্থানে সংখ্যালঘু সম্প্রদায় ও তাদের বিভিন্ন স্থাপনার ওপর হামলার অভিযোগ উঠেছে।
সেসময় সরকারের দিক থেকে কেউ কেউ বলার চেষ্টা করেছেন যে সংখ্যালঘুদের মধ্যে যারা বিগত আওয়ামী লীগ সরকার কিংবা দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলো তারা কেউ কেউ আক্রান্ত হয়েছেন, তবে ‘সংখ্যালঘু বলে কেউ আক্রমণের শিকার হন নি’।
যদিও ওই সময়ের মধ্যে অন্তত উনত্রিশটি জেলায় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বাড়িঘর, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ও উপাসনালয়ে ভাঙচুর ও লুটপাটের অভিযোগ করেছিলো হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ।
পরে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারেও ‘সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা ও ভাংচুরের নিন্দা জানিয়ে মানববন্ধন ও প্রতিবাদ মিছিল’ করা হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে।
তেরোই অগাস্ট মঙ্গলবার প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস তার বাসভবনে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নেতাদের সাথে বৈঠক করেন, যেখানে ইসকন, পূজা উদযাপন পরিষদ ও ঐক্য পরিষদের প্রতিনিধিরাও ছিলেন।
প্রধান উপদেষ্টা পরে দুর্গাপূজার সময় কঠোর নিরাপত্তার পাশাপাশি মন্দির ও উপাসনালয়গুলোতে মাদ্রাসা ছাত্রদের পাহারা দেয়ার ছবিও আলোচিত হয়েছে সামাজিক মাধ্যমে।
হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের প্রেসিডিয়াম সদস্য অ্যাডভোকেট সুব্রত চৌধুরী বলছেন, ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর যেসব ঘটনা ঘটেছে তাতে ত্বরিত ব্যবস্থা নেয়া হয়নি বলেই এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।
“এখনো টুকটাক হচ্ছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অনেক শিক্ষককে জবরদস্তিমূলক পদত্যাগে বাধ্য করা হয়েছে। সরকারের চরম ব্যর্থতা আছে এখানে। মনে হচ্ছে সরকারের মধ্যে অস্থিরতা ও একটা গ্যাপ আছে। ব্যবস্থা নেয়ায় অনীহা আছে,” বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন তিনি।
তবে পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে ওঠে সনাতনী জাগরণ মঞ্চ দেশজুড়ে সমাবেশ শুরুর পর।
বিবিসি বাংলার খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল অনুসরণ করুন।
সনাতন জাগরণ মঞ্চ ও ইসকন
গত পঁচিশে অক্টোবর চট্টগ্রামের লালদীঘি ময়দানে সমাবেশের আয়োজন করে সনাতন জাগরণ মঞ্চ এবং সেই সমাবেশে প্রধান বক্তা ছিলেন চিন্ময় কৃষ্ণ দাস, যনি এখন রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলায় আটক হয়ে কারাগারে আছেন।
ওই সমাবেশ থেকে আট দফা দাবি জানানো হয়। তার মধ্যে আছে দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল গঠন করে সংখ্যালঘু নির্যাতনে জড়িতদের উপযুক্ত শাস্তি, ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণ ও পুনর্বাসন এবং অবিলম্বে সংখ্যালঘু সুরক্ষা আইন প্রণয়ন করা।
সমাবেশে দেয়া ভাষণে মি. দাস বলেছিলেন “কেউ যদি আমাদের উৎখাত করে শান্তিতে থাকার চেষ্টা করেন, তাহলে এ ভূমি আফগানিস্তান হবে, সিরিয়া হবে”।
“শুধু সংখ্যালঘু পরিচয়ে ৯৩ জনকে পুলিশের চাকরি থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। ভেটেরিনারি ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে হিন্দুদের চিহ্নিত করা হচ্ছে। মাঝখানে কিছুদিন এমন অপকর্ম থেমে গিয়েছিল। এখন মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। আমরা আর নীরব থাকব না,” বলেছেন তিনি।
লালদীঘির সমাবেশের ছবি ও তার বক্তব্য সামাজিক মাধ্যমে ব্যাপকভাবে আলোচনায় আসে। এরপর একই দাবিতে তিনি রংপুরেও সমাবেশ করেন।
কিন্তু এর মধ্যেই আলোচনায় উঠে আসে ইসকন প্রসঙ্গ। নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে চট্টগ্রাম নগরীর টেরিবাজার এলাকায় হিন্দু অধ্যুষিত হাজারী গলিতে ‘ইসকন নিয়ে ফেসবুকে দেয়া পোস্ট’কে কেন্দ্র করে অন্তত ৮২ জনকে আটক করে পুলিশ। এ ঘটনায় ওই এলাকায় যৌথবাহিনীর ব্যাপক অভিযান চালায়, যাতে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন হিন্দু সম্প্রদায়ের নেতারা।
এর আগে ইসকন সংবাদ সম্মেলন করে তাদের নিয়ে ‘অসত্য’ বক্তব্য দেয়ার অভিযোগ করে আমার দেশ পত্রিকার সম্পাদক মাহমুদুর রহমানের তীব্র সমালোচনা করেছে।
মি. রহমান এক অনুষ্ঠানে ‘ইসকনকে সাম্প্রদায়িক ও ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা র-এর’ সংগঠন হিসেবে মন্তব্য করেছিলেন। তখন ইসকন এক বিবৃতিতে বলেছে এটি একটি অরাজনৈতিক ও শান্তিপূর্ণ ধর্মীয় সংগঠন।
কিন্তু সনাতনী জাগরণ মঞ্চের চট্টগ্রাম ও রংপুরের সমাবেশের পর চিন্ময় কৃষ্ণ দাস ইসকন নেতা বলে প্রচার শুরু হয় সামাজিক মাধ্যমে। কেউ কেউ ‘ইসকনকে নিষিদ্ধ করার’ দাবি জানাতে থাকেন।
তবে ইসকন জানিয়েছে যে মি. দাস ও সনাতনী জাগরণ মঞ্চের সাথে ইসকনের কোন সম্পর্ক নেই।
এমন পরিস্থিতিতে সোমবার ঢাকা থেকে চিন্ময় কৃষ্ণ দাসকে আটক করে গোয়েন্দা পুলিশ। পরদিন তাকে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলায় তাকে গ্রেফতার দেখিয়ে তাকে আদালতে উপস্থাপন করা হয়। এসময় তার অনেক অনুসারী সেখানে জমায়েত হন। এ নিয়ে সংঘর্ষ হয় সেখানে। সংঘর্ষ চলাকালে আদালতের মূল ফটকের উল্টো দিকের এক গলিতে নিহত হন আইনজীবী সাইফুল ইসলাম।
এ ঘটনায় তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে ভারত। পাল্টা প্রতিক্রিয়া দেখায় বাংলাদেশও। উভয় দেশের সামাজিক মাধ্যমে পরস্পরবিরোধী ব্যাপক প্রচারণা শুরু হয়।
সুব্রত চৌধুরী বলছেন ‘চিন্ময় কৃষ্ণ দাসের ঘটনাও সরকার ঠিকমতো হ্যান্ডেল করতে পারেনি। তিনি এমন কিছু করেননি যে রাষ্ট্রদ্রোহিতা হবে। তিনি কোন সহিংসতাও করেননি। বরং শান্তিপূর্ণ ভাবে সমাবেশ করে দাবি তুলে ধরেছেন। আবার চট্টগ্রামে যখন আইনজীবী হত্যা হলো তখন পুলিশ কোন পদক্ষেপ নিলো না কেন?”
চিন্ময় কৃষ্ণ দাসের গ্রেফতারের পর ভারতের হিন্দুত্ববাদী দলগুলো বেশ আগ্রাসী প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে শুরু করে। বাংলাদেশেও শুরু হয় ইসকন ও ভারত বিরোধী প্রচারণা।
বিবৃতি আসে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকেও। যেখানে বলা হয় ‘সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার ঘটনায় অপরাধীরা যেখানে ধরা ছোঁয়ার বাইরে সেখানে একজন ধর্মীয় নেতা এসব অন্যায়ের বিরুদ্ধে যখন কথা বলেছে তার বিরুদ্ধে পাল্টা অভিযোগ এনে গ্রেফতার করা হয়েছে’।
ভারতের উদ্বেগ প্রকাশের পাল্টা বিবৃতিতে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র দপ্তর বলেছে, ‘চিন্ময় কৃষ্ণ দাসকে নির্দিষ্ট অভিযোগে গ্রেপ্তারের পর থেকে কিছু মহল তা নিয়ে ভুল তথ্য ছড়িয়ে দিচ্ছে। এমন অপ্রমাণিত বিবৃতি শুধু সত্যের অপলাপই নয়, একই সঙ্গে তা দুই প্রতিবেশী দেশের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ও বোঝাপড়ার চেতনার পরিপন্থী।’
এরপর বৃহস্পতিবার কলকাতায় বাংলাদেশের ডেপুটি হাইকমিশনের সামনে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা ও প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের কুশপুত্তলিকা পোড়ানো হলে তার তীব্র নিন্দা জানিয়ে বিবৃতি দেয় বাংলাদেশ সরকার।
শুক্রবার ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাপ্তাহিক ব্রিফিংয়েও উঠে আসে বাংলাদেশ প্রসঙ্গ। মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রণধীর জয়সওয়াল বলেন, “আমাদের অবস্থান খুব স্পষ্ট। বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারকে অবশ্যই সব সংখ্যালঘুর নিরাপত্তার দায়িত্ব নিতে হবে”।
বাংলাদেশেও সরকারের কয়েক উপদেষ্টা ভারতকে ইঙ্গিত করে নানা ধরনের মন্তব্য করেছেন।
আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল তার ভেরিফায়েড ফেসবুক পাতায় লিখেছেন যে ‘..বাংলাদেশের পরিস্থিতি নিয়ে ভারতের অযাচিত উদ্বেগ প্রকাশ থেমে নেই। ভারতের নিজেদের মাটিতে সংখ্যালঘু মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষের উপর অসংখ্য নির্মমতার ঘটনা ঘটে চলেছে। অথচ সেটা নিয়ে তাদের সংকোচ বা অনুশোচনা নেই। ভারতের এই দ্বিচারিতা নিন্দনীয় ও আপত্তিকর’।
তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম চিন্ময় কৃষ্ণ দাসকে গ্রেপ্তারের ঘটনায় উদ্বেগ জানিয়ে বিবৃতি দেওয়াকে ভারতের “অনধিকার চর্চা” বলে অভিহিত করেছেন। বিবিসি বাংলাকে তিনি বলেছিলেন যে ‘তারা (ভারত) ঘটনাকে আরও উস্কে দেয়ার চেষ্টা করছে’।